শনিবার, ০৩ জুন ২০২৩, ২০ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০
সুধীর বরণ মাঝি।।
দেশ জুড়ে জনসংখ্যা বাড়লেও মানুষের সংখ্যা কমেছে। মানুষের সংখ্যা যেমন কমেছে ঠিক তেমনি কমেছে মানবিকতা, মানবিক মূল্যবোধ,সৌহর্দ্য-সম্প্রীতি নৈতিকতা। আমরা দিন দিন হারিয়ে ফেলছি আমাদের কৃষ্টি , সংস্কৃতি, স্নেহ, মমতা, আদর্শ, পারস্পারিক শ্রদ্ধা, ভালোবাসা,মমত্ববোধ। দিন দিন হিংস্র হয়ে উঠেছে আমাদের সভ্য সমাজ, পরিবার, ব্যক্তি চিন্তা, ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক দলগুলো। আমিত্ব, ব্যক্তি কেন্দ্রিক, ব্যক্তি নির্ভর পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র যেন ব্যক্তি স্বার্থের সূতিকাগার হয়ে উঠেছে। প্রায় সবাই ব্যস্ত সময় পাড় করছি আপন আপন হীন স্বার্থ ভাবনায়। প্রত্যেকেই যেন তার নৈতিকতা, মূল্যবোধ, মানবিক গুণাবলীকে বিসর্জন দিয়ে স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক মানুষ হওয়ার চূড়ান্ত প্রতিযোগিতায়। গুজবে কান দিয়ে আমারা আমাদের সহমর্মিতা এবং সম্প্রীতিকে বিভীষিকাময় করে তুলছি আবার সাথে সত্যকে না মানতে জড়িয়ে পড়ছি সংঘর্ষে। এইভাবে একটি সমাজ রাষ্ট্র চলতে পারলেও বেশি দূর এগিয়ে যাওযা সম্ভব নয়। ব্যক্তিচিন্তা এবং সংস্কৃতি থেকে আমাদেরকে বেড়িয়ে আসতে হবে আমাদের নিজেদের স্বার্থে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এবং ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধ ও উন্নত বাংলাদেশের জন্য। আর তা না হলে পারিবারিক, সাসাজিক ও রাষ্ট্রীয় বন্ধন ব্যহত হবে। পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে দেখা দিবে চরম বিশৃঙ্খখলা, নৈরাজ্য, সামাজিক বৈষম্য। একদল মুখোশপড়া মানুষ বাজার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করে বিদেশে পাচার করে দিচ্ছে। ভেঙ্গে পড়েছে বাজার অর্থনীতি। ক্রমান্নয়ে বেড়েছে সাধারণ মানুষের দীর্ঘশ্বাস। অপমৃত্যুতে ভারী হয়ে উঠেছে মুক্ত বাতাস। সনদপত্র কেন্দ্রিক শিক্ষা বাড়লেও শিক্ষার মান এবং শিক্ষার বিকাশ মুখ থুবড়ে পড়েছে। স্বার্থপর বিশ্বাসে কুঠারাঘাত করতে হবে, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফিরিয়ে আনতে হবে। দেশে নারী ও শিশুর ওপর সহিংসতা বেড়েছে। শারীরিক, মানসিক, যৌন নির্যাতন ছাড়াও ধর্ষণ ও হত্যা করার মতো ঘটনা ঘটছে। এর বেশির ভাগই রাস্তায়, নিজ বাসায় ও স্বজনদের দ্বারা নির্যাতনের শিকার। ঘরকেই সর্বোচ্চ নিরাপদ স্থান হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও অনেক নারী ও কন্যাশিশুর জন্য ঘরও অনিরাপদ হয়ে উঠেছে। এমন ঘটনা খুবই উদ্বেগজনক।
রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবে জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম জাতীয় কন্যাশিশু দিবস উপলক্ষে ‘কন্যাশিশু পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন-২০২২’ প্রকাশ করে। ২০২২ সালের প্রথম ৮ মাসে দেশের ২৪টি জাতীয়, স্থানীয় ও অনলাইন সংবাদমাধ্যম থেকে কন্যাশিশুদের প্রতি নির্যাতনের তথ্য সংগ্রহ করে এ ফোরাম। প্রতিবেদনে বলা হযেছে, জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ৫৭৪ জন কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়। এর মধ্যে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার ৮৪ ও ৪৩ জন প্রতিবন্ধী কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়। প্রেমের অভিনয় ও বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ৪৯ জন কন্যাশিশুকে ধর্ষণ করা হয়েছে। ধর্ষণের পর ২০ জনকে হত্যা করা হয়েছে। ৮৭ জন কন্যাশিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। এ ছাড়া যৌন হয়রানির স্বীকার হয়েছে ৭৬ জন। ধর্ষণ ও দলব্ধ ধর্ষণের মত জঘন্যতম অপরাধের শিকার হতে হচ্ছে এক বছর বয়সের শিশুদেরও। এর মধ্যে কয়েকজন তাদের নিকটাত্মীয়ের মাধ্যমে ধর্ষিত হয়েছে। বিদেশে পাচার, নির্যাতন, অপমৃত্যু, হত্যা এর পরিসংখ্যান তথ্য খুবই ভয়ংকর। কোন সভ্য দেশেই এই পরিসংখ্যান এবং এই ঘটানার ক্রমাগত বৃদ্ধি কাম্য নয়। পুঁজিবাদী অর্থনীতি এবং ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি বিষবাষ্প যে ভাবে ছড়িয়ে পড়ছে তাতে করে সুস্থভাবে বেঁচে থাকা এবং মুক্ত চিন্তার বিকাশের মাধ্যমে একটি সুস্থ ও সমৃদ্ধ জাতিগঠন আমাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে।পুঁজিবাদী অর্থনীতি এবং ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি আমাদেরকে এবং আমাদের আগামী প্রজন্মকে স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক মানুষ হিসেবে গড়ে তুলছে।
নিত্যপণ্যের বাজারে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি এবং কৃত্রিম সংকটের মাধ্যমে অস্থিরতা তৈরি করা হয়েছে। চাল, আটা, ময়দা, ডিম, মুরগি, বিস্কুট, নুডুলস, কাগজ, বৈদ্যতিক সরঞ্জাম, শিক্ষা উপকরণ, টয়লেট্রিজ পণ্য ইত্যাদি বিক্রির ক্ষেত্রে অতি মুনাফার কারণে মানুষের জীবনমান গভীর সংকটের মুখে পড়েছে। ফলে একদিকে সাধারণ মানুষের ঋণের বোঝা বাড়ছে এবং কোথাও কোথাও ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে এবং অন্যদিকে কিছু মানুষ রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে বটগাছ হচ্ছে সেই সাথে দেশের অর্থনীতিকে গভীর সংকটের মুখে ফেলে দিচ্ছে বিদেশে টাকা পাচারের মাধ্যমে। নিত্যপণ্যের বাজারে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি এবং কৃত্রিম সংকটের মাধ্যমে অস্থিরতা তৈরির প্রমাণ পেয়ে প্রতিযোগিতা কমিশন (বিসিসি) প্রাণ, স্কয়ার, এসিআই, আকিজ, সিটি গ্রুপ, মেঘনা, ইউনিলিভার, বসুন্ধরা গ্রুপসহ ১১ ব্যক্তি ও ৩৬ কোম্পানি এবং ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ৪৪টি মামলা করেছে। বাংলাদেশ ২২ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার কমিশন সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে, যা বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গত নয় মাসে দেশে রাজনৈতিক সংঘাত ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে মোট ৩৮৭টি। এতে নিহত হয়েছেন ৫৮ জন এবং আহত হয়েছেন ৫ হাজার ৪০০ জন। এ পরিসংখ্যান সঠিক হয়ে থাকলে তা উদ্বেগজনক বৈকি। আসকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্থানীয় নির্বাচনসহ রাজনৈতিক কারণে দেশের প্রায় সব জেলায় এসব সহিংস ঘটনা ঘটেছে। সারা দেশে ২১৬০ কোটি টাকা চাঁদাবাজি। দেশজুড়ে কিশোর গ্যাং কালচার দিন দিন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। কিশোর গ্যাং এর কারণে চুরি, ছিনতাই, যৌন হয়রানি, মাদক ব্যবসায়সহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে কিশোররা। কিশোর অপরাধীরা বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে হয়ে উঠছে ভয়ঙ্কর অপরাধী, এলাকার ত্রাস। আরো উদ্বেগের বিষয়, ভাড়াটে হিসেবে তারা মানুষ হত্যা কিংবা নির্যাতনের মতো অপরাধে যুক্ত হচ্ছে। তাদের অত্যাচার থেকে রেহাই পাচ্ছে না জন্মদাতা মা-বাবা ও ভাইবোন। শিক্ষকরা দিন দিন সম্মানের দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়ছেন। সম্প্রতি তাদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতাও দেখা দিয়েছে। অনেক শিক্ষক শিকার হয়েছেন নির্যাতনের। বাংলাদেশ ব্যাংকের সমমূলধন উদ্যোক্তা তহবিল (ইইএফ) থেকে বিনাসুদে নেওয়া ৮১২ কোটি টাকা গচ্চা গেছে। এ তহবিল থেকে ৫৭৭টি প্রতিষ্ঠানকে ১ হাজার ৫ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছিল। এসব উদ্যোক্তা ভুয়া কাগজপত্র বানিয়ে ঋণ নিয়েছিল। সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ে দেওয়া সরকারের নিরীক্ষা বিভাগের একটি প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে শিল্পঋণে খেলাপি ৫৮ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে প্রায় ৩০ শতাংশ, বিশেষায়িত ব্যাংকে ২৪ দশমিক ৬২ শতাংশ আছে।রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে ২২ দশমিক ৫৬ শতাংশ এবং ১০টি ব্যাংক ও ২১টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ১৫ শতাংশের বেশি খেলাপি ঋণ রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঋণ বিতরণে যথাযথ নিয়ম মানা হচ্ছে না। ফলে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। ঘুরেফিরে ঋণ পাচ্ছেন একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীরা। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, তারা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় ব্যাংকের টাকা ফেরত দেন না। আবার কেউ কেউ নামে-বেনামে ব্যাংক থেকে টাকা বের করে বিদেশে পাচার করছেন। সাধারণত এসব টাকা আর ফেরত আসে না। ফলে খেলাপি ঋণ বেড়েই চলেছে।
একটি ইতিবাচক সাংস্কৃতিক পরির্বতন জরুরী । যেখানে মানুষ তার সহমর্মিতা, মমত্ববোধ, পারস্পারিক শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, মানবিক গুণাবলী ফিরে আসবে। রক্তের বিনিময়ে, মা-বোনের ইজ্জতের বিনময়ে অর্জিত লাল সবুজের পতাকার বাংলাদেশকে সোনার বাংলাদেশ গড়তে প্রয়োজন সোনার মানুষ। একটি সাংস্কৃতিক পরিবর্তন খুবই জরুরী। যার মধ্য দিয়ে মানবিক মূল্যবোধ,সততা,নিষ্ঠামনুষ্যত্ব জাগ্রত হবে। শিক্ষা ক্ষেত্রেও ব্যাপক পরিবর্তন দরকার । যেই শিক্ষার মধ্য দিয়ে আমাদের দেশের মানুষ মানবিক মানুষ, আগামী প্রজন্ম মানবিক প্রজন্ম হয়ে গেড়ে উঠবে।
লেখক: শিক্ষক, হাইমচর সরকারি মহিাবিদ্যালয়, হাইমচর, চাঁদপুর।