মো.সাকিবুজ্জামান সবুর, কাঠালিয়া।।
ঝালকাঠি জেলার শিক্ষা-চিকিৎসাসহ বিভিন্ন নাগরিক সুবিধা বঞ্চিত নদী বিধৌত কাঠালিয়া উপজেলার সিংহভাগ মানুষ এনজিও ঋণ এবং প্রকৃতিক দূর্যোগের সাথে সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হচ্ছে। এখানকার জীবন-জীবিকার অন্যতম উৎস্য কৃষি ও মৎস্য। সরকার পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় রাস্তা-ঘাট ও অবকাঠামোর উন্নয়ন অব্যাহত থাকলেও যুগপযোগী ও গুনগত শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ, দয়িত্ববোধ, তদারকি ও অভিভাবকদের সচেতনতার অভাবে কাঠালিয়ার ভবিষ্যত প্রজন্ম কোমলমতি শিক্ষার্থীরা দিনে দিনে স্কুল ও পড়ার টেবিলের পরিবর্তে মাদক, মোবাইল আসক্ত ও কোচিং-প্রাইভেট বাণিজ্যের সিন্ডিকেটে জিম্মী। যে কারণে জেএসসি, এসএসসি ও সমমানসহ বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষা কেন্দ্রে নকলের প্রবাণতা ও শিক্ষক-অভিভাবকদের সহায়তা নামক এ ব্যাধীটি ক্যান্সারে রূপ নিয়েছিল।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার আকন্দ মোহাম্মাদ ফয়সাল উদ্দীন কাঠালিয়ায় যোগদানের পর কাঠালিয়ার মানব সম্পদ উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রথমেই হাত দেন শিক্ষা সেক্টরে। তাঁর সৃজনশীল মেধা, কঠোর পরিশ্রম ও যুযোপযোগী ব্যতিক্রমী উদ্যোগ গ্রহণের ফলে কয়েক মাসের ব্যবধানে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় আমুল পরিবর্তন ঘটে। তাঁর কর্মকালীন গত দুই বছরে দূর্নীতি ও ফাঁকিবাজ শিক্ষকদের অনেককে বিবেকের আদালতে হাজির করে দায়িত্ব পালনে আন্তরিক করা, শিক্ষার্থীদের পড়ার টেবিলে বাসার উদ্যোগ, অভিভাবকদের পরামর্শ ও সচেতনতা সৃষ্টি, টেষ্ট পরীক্ষায় অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদেরকে ফরমপূরণে বিরত রাখা, পরীক্ষায় সহায়তার নামে শিক্ষার্থীদেরকে জিম্মী করা কোচিং বাণিজ্য বন্ধ, সম্পূর্ণ নকলমুক্ত পরিবেশে পরীক্ষা উপহার দেয়ায় শিক্ষার মানন্নোয়নে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। বিজ্ঞান ভিত্তিক সৃজনশীল চর্চার জন্য বিজ্ঞান ক্লাবের মাধ্যমে উপজেলায় প্রথমবারের মতো পরপর দু‘বার শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান অলিম্পিয়ানে চ্যাম্পিয়ান ও বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ পায়। উপজেলা পরিষদের অর্থায়নে উচ্চ মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক স্তরের মেধাবী ও অসচ্ছল ১৫০জন শিক্ষার্থীকে ৪ লক্ষ নগদ টাকা বৃত্তি প্রদান করা হয়। এছাড়া সহশিক্ষা কার্যক্রম ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগীতায় স্বত:স্ফুত অংশ গ্রহনে উৎসাহিত করেন। উপজেলা নির্বাহী অফিসার আকন্দ মোহাম্মদ ফয়সাল উদ্দীনের উদ্যোগে বাল্যবিবাহ বিরোধী দুরন্ত কাঠালিয়ান নেটওয়ার্ক গঠন ও ৪০টি বিদ্যালয়ের ৯১জন ছাত্রীর হাতে বাইসাইকেল তুলে দেন। যা পরবর্তীতে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে ব্যাপক ভূমিকা রাখে।
এছাড়াও উপজেলা দূর্নীতির আখরা হিসেবে পরিচিত উপজেলা ভূমি অফিসটি দূর্নীতি ও হয়রানী মুক্ত করেন তিনি। যার ফলে জমি নামজারী করতে হাজার হাজার টাকা ঘূষ লেনদেন ও হয়রাণী বন্ধ হয়। সরকার নির্ধারিত মাত্র ১১৫০টাকায় জমির নামজারী করতে পারছেন সেবাগ্রহিতা। অসহায় গরীব লোকজন বিনা খরচে পর্চা তুলতে পারতেন। ভূয়া কাগজপত্র দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা হওয়া উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা যাছাই-বাছাই কমিটি কর্তৃক ‘গ’ তালিকাভূক্ত ১৩জন (ভাতাভোগী) ভাতা বন্ধসহ বিধিগত ব্যবস্থা গ্রহন করেন। উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ বড় কাঠালিয়া ও পশ্চিম আউরার খালসহ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় অনেক খালে প্রভাবশালীরা স্থায়ী বাঁধ দিয়ে বছরের পর বছর মাছের চাষ ও অবৈধভাবে খাল দখল করার কারণে কৃষকদের শতশত একর জমির ফসল নষ্ট ও অনাবাদি ছিল। ইউএনও ফয়সাল উদ্দীন তাঁর আপোষহীন সাহসী পদক্ষেপে ওইসব খালগুলোর বাঁধ কেটে পানি নিস্কাসনের ব্যবস্থা ও অবৈধ দক্ষমুক্ত করায় সর্ব মহলে প্রসংশিত হন। ঘর্ণিঝড় বুলবুল ও আম্পানসহ প্রাকৃতিক দূর্যোগে জনসাধারণের জানমালের নিরাপত্তায় আগাম সর্তকবার্তা, মনিটনিং সহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করায় প্রাণহানীসহ ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি থেকে কাঠালিয়াবাসী রক্ষা পায়। বিশেষ করে বিশ্বমহামারি করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রামন প্রতিরোধে স্বাস্থ্য বিভাগ, থানা পুলিশ, জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সহযোগীতায় লোকজনকে সচেতনতা বৃদ্ধি, প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের না হওয়া এবং মাস্ক ব্যবহারে কঠোরতার কারণে আল্লাহর অসীম রহমতে অন্যান্য উপজেলার তুলনায় কাঠালিয়ায় করোনা পজেটিভ (আক্রান্ত) মাত্র ৯জন। এদের মধ্যে ৭জনই এখন সুস্থ।
এছাড়া অবৈধ কারেন্টজাল, জাকটা নিধন ও বাজার দর নিয়ন্ত্রণে রাখতে অভিযান পরিচালনা করে ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে জেলা-জরিমান অব্যাহত রেখেছেন। তাঁর কঠোর মনিটরিংয়ের মাধ্যমে উপজেলার সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প ও নির্মানাধীণ ভবন/সড়কের কাজ শতভাগ নিশ্চিত ও বাস্তবায়নের প্রভাব পড়েছিল সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে। নিম্ন মানের সামগ্রী দিয়ে সরকারি নির্মানাধীন ভবনের ছাদ থেকে পানি চুষে পড়ায় ওই ভবন ভেঙ্গে পুনরায় নির্মাণ করার নজির রয়েছে।
২০২০ সালের এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থী উম্মে জান্নাত তামান্না জানান, ইউএনও স্যার কাঠালিয়ায় শিক্ষার ক্ষেত্রে সম্মৃদ্ধি এনেছেন। বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে মেধাবীদের খুঁজে বের করেছেন। উৎসাহিত করার জন্য বিভিন্ন সময় আমাদেরকে গিফট দিতেন এবং মাঝে মাঝে ট্যুরে নিয়ে যেতেন। পরীক্ষার হল ছিলো নকল ও কোলাহলমুক্ত। ইউএনও স্যারের কথা বলতে গেলে শেষ হবে না। তিনি ছিলেন আমাদের বন্ধুর মতোন। মাঝে মধ্যে স্যার আমাদের খোঁজ খবর নিতেন। অভিভাবকের সাথে মোবাইলে পড়াশুনা নিয়ে কথা বলতেন। স্যার চলে যাচ্ছেন শুনে খুবই খারাপ লাগছে।
আমুয়া শহীদ রাজা ডিগ্রী কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সমীর সাহা জানান, ইউএনও আকন্দ মোহাম্মাদ ফয়সাল উদ্দীন স্যার কাঠালিয়ায় যোগদানের পর থেকেই শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন ও বিজ্ঞান ভিত্তিক মনস্তাত্ত্বিক পরিচালনার জন্য ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় আমাকে অভিভূত করেছেন। তিনি প্রতি মুহুর্তে শিক্ষা ও শিক্ষার্থীদের বিকাশে তার প্রশংসা দাবিদার। বিভিন্ন সহ শিক্ষার কার্যক্রম বিতর্ক, সাংকৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করে গেছেন। সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ ছিল নকল মুক্ত পরিবেশে সকল পাবলিক পরিক্ষা পরিচালনা করা। এছাড়াও তিনি নিয়মিত সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পর্ক ও যোগাযোগ রক্ষা করে চলছেন। যেটা শিক্ষার্থী ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠিানকে শিক্ষার পরিবেশ সুষ্ঠুভাবে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছেন।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার আকন্দ মোহাম্মদ ফয়সাল উদ্দীন বলেন, আমি কাঠালিয়ায় দায়িত্বভার গ্রহণের পর উপলব্ধী করি, কাঠালিয়ায় মানব সম্পদ উন্নয়ন ছাড়া কোন বিকল্প নেই। নতুন প্রজন্মকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত, কারিগরি প্রশিক্ষণ দিয়ে বিদেশে পাঠানো এবং কৃষি জমির উপযুক্ত ব্যবহার করতে পারলে এখান থেকে কিছু মেধাবী শিক্ষার্থী বের হয়ে বিসিএসসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে যাওয়া সম্ভব। কম শিক্ষিত/ বেকারদেরকে হাতের কাজ শিখিয়ে জনশক্তি তৈরি করে উন্নত দেশে পাঠানো এবং কৃষি ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে হবে। এটা মাথায় নিয়ে অনেক প্রতিকূলতা মধ্যে থেকেও সকলের সহযোগীতা ও আন্তরিকতায় কাঠালিয়াতে শিক্ষার সুন্দর পরিবেশ তৈরি করতে চেষ্টা করেছি।