সোমবার, ০২ অক্টোবর ২০২৩, ১৭ আশ্বিন, ১৪৩০
করোনাভাইরাস সংকটের মধ্যে অনেকটা আকস্মিকভাবে বিনা ভাড়ায় চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার রাখার সুযোগ বন্ধ করে দিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। শনিবার এ সংক্রান্ত এক সার্কুলার জারি করা হয়েছে।
এতে বিনা ভাড়ায় কনটেইনার নিতে সোমবার পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়া হয়েছে। এ সময় পার হওয়ার পর বন্দর থেকে কনটেইনার বের করতে হলে স্বাভাবিক সময়ের মতোই ভাড়া পরিশোধ করতে হবে। কনটেইনার জট কমানোর উদ্দেশ্যে এ সার্কুলার জারি করা হয়েছে বলে দাবি করেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো এসব তথ্য জানিয়েছে।
এদিকে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের এমন সিদ্ধান্তে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বন্দর ব্যবহারকারীরা। তারা বলেন, এত অল্প সময়ে সব প্রক্রিয়া শেষ করে কনটেইনার নেয়া সম্ভব নয়। করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে অচলাবস্থা বিরাজ করছে। এমন পরিস্থিতিতে পাশের দেশ ভারত বন্দর ব্যবহারকারীদের বিশেষ সুবিধা দিয়েছে। বন্দর ও শিপিং লাইনের ডেমারেজ মওকুফ করেছে অনেক আগেই। অথচ আমাদের দেশে শিল্প মালিক ও ব্যবসায়ীদের পর্যাপ্ত সময় না দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের জারি করা এ ধরনের সার্কুলার নতুন সংকট তৈরি করবে।
এ বিষয়ে এফবিসিসিআই’র সহসভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে লকডাউন না খুললে শিল্প মালিকরা কিভাবে কনটেইনার নেবে। এখন কাস্টমস খোলা থাকলে, ব্যাংক বন্ধ থাকে। ব্যাংক খোলা থাকলে সিএন্ডএফ এজেন্টরা যাচ্ছে না। এ সমন্বয়ের অভাবে শিল্প মালিকরা চাইলেও কনটেইনার খালাস নিতে পারছে না। আর এ অনাকাঙ্ক্ষিত প্রেক্ষাপটে ব্যবসায়ীদের ডেমারেজ দেয়াও সম্ভব নয়। কনটেইনার খালাসের বিষয়ে ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ যে সার্কুলার দিয়েছে, সেটার কোনো যৌক্তিকতা নেই। কারণ সার্কুলারে দুই দিন সময় দেয়া হয়েছে। এ সার্কুলার ব্যবসায়ীদের কাছে পৌঁছতেই দুই দিনের বেশি সময় লাগবে। তিনি মনে করেন, লকডাউন ওঠার পরও শিল্প মালিকদের কনটেইনার নিতে সাত দিন সময় দিতে হবে। আর এ সময় ভারতের মতো সব ধরনের চার্জ মওকুফ করতে হবে। একই ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন আরও কয়েকটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক সংগঠনের নেতারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী রোববার যুগান্তরকে বলেন, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বন্দর ব্যবহারকারীদের কনটেইনার রাখার ফি মওকুফ করা হয়েছিল। তাদের সুযোগও দেয়া হয়েছে। কিন্তু ব্যবসায়ীরা কনটেইনার নেননি। এতে বন্দরে কনটেইনার জট তৈরি হয়েছে। এ কারণে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এর আগেও একবার তাদের সুযোগ দেয়া হয়েছিল। এরপরও কেউ সংকটে পড়লে কেস টু কেস বিচার-বিশ্লেষণ করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
কনটেইনার জট কমাতে অন্য কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়েছে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এসএম আবুল কালাম আজাদ যুগান্তরকে বলেন, বন্দরের ইয়ার্ডে ৩৯ হাজার টিইইউএস কনটেইনার রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে চট্টগ্রামে ১৩ এপ্রিল সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে বৈঠক করেছি। ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্ট সব সংস্থাকে কনটেইনার জট কমাতে এগিয়ে আসার আহবান জানানো হয়েছে। ওই সভার সুপারিশ অনুযায়ী সব ধরনের কনটেইনার ১৯টি অফডকে (প্রাইভেট আইসিডি) সংরক্ষণের জন্য এনবিআরকে চিঠি দেয়া হয়েছে। এনবিআর আরও ছয় ধরনের পণ্য অফডকে সংরক্ষণের অনুমতি দিয়েছে। এতেও কনটেইনার জট কিছুটা হলেও কমবে বলে আশা করছি।
তবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের এসব পদক্ষেপে সন্তুষ্ট নন ব্যবসায়ীরা। চট্টগ্রাম বন্দর ও এনবিআরসহ সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার মধ্যে সমন্বয় ছাড়াই কনটেইনারের স্টোররেন্ট মওকুফের সিদ্ধান্ত বাতিল করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তারা বলেন, সারা দেশে অচলাবস্থার কারণে লরি ও ট্রাকের ঘাটতি রয়েছে। অনেক চালক ও হেলপার বাড়ি গিয়ে আর ফিরতে পারেননি। বন্দর থেকে কনটেইনার নিতে হলে আরও কিছুটা সময়ের প্রয়োজন। এ বিষয়ে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, ১৮ তারিখ সার্কুলার জারি করে ২০ তারিখের মধ্যে মালামাল নিতে বললে ব্যবসায়ীরা কীভাবে নেবে? অফিস খোলা আছে নামেমাত্র। ৫-৭ কর্মকর্তা থাকেন। এরপরও তারা ঠিকমতো অফিস করেন না। সিএন্ডএফ এজেন্টরা কর্মকর্তাদের মোটরসাইকেলে করে নিয়ে এসে এরপর অ্যাসেসমেন্ট মাল খালাস করছে। তিনি আরও বলেন, ১৮ তারিখ সার্কুলার জারি করলেও ব্যবসায়ীরা তা হাতে পেয়েছে ১৯ তারিখে। কিভাবে এ পরিস্থিতিতে একদিনের মধ্যে অ্যাসেসমেন্ট, এক্সামিন ও ডেলিভারি সম্ভব? এ বাস্তবতা কী যারা অর্ডার করেছেন তারা বোঝেন না।
বিকেএমইএ’র জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে এ সার্কুলার করা হয়নি। একদিনের মধ্যে কিভাবে মালামাল নেয়া সম্ভব। স্বাভাবিক সময়ে যখন সম্পূর্ণ জনবল কাজ করে তখনও কনটেইনার খালাসে ৩-৪ দিন লাগে। যদি বন্দর কর্তৃপক্ষ এ দুর্যোগে সহায়তা করতে চায় তাহলে অন্তত এক সপ্তাহ সময় দেয়া প্রয়োজন, তাতেও কাজ হবে বলে মনে হয় না।
জানা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ শনিবার অনেকটা আকস্মিকভাবে কনটেইনার স্টোররেন্ট মওকুফের সিদ্ধান্ত বাতিল করে সার্কুলার জারি করেছে। এতে করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ ও বিস্তার প্রতিরোধের লক্ষ্যে সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটি চলাকালে ২৭ মার্চ থেকে ২০ এপ্রিল পর্যন্ত বন্দরের ভেতরে খালাস গ্রহণ করা হলে ওই কনটেইনারগুলোর স্টোররেন্ট শতভাগ মওকুফযোগ্য হবে। ২০ এপ্রিলের পর এসব কনটেইনার ডেলিভারি নেয়া হলে সেক্ষেত্রে অত্র মওকুফ প্রযোজ্য হবে না এবং যথারীতি প্রচলিত নিয়মে স্টোররেন্ট পরিশোধ করতে হবে। এ সার্কুলার জারির নেপথ্যে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের যুক্তি, বন্দরের ইয়ার্ডে দীর্ঘদিন কনটেইনার পড়ে থাকায় জট তৈরি হয়েছে। এ কারণে বহির্নোঙরে অনেক জাহাজ পণ্য খালাসের অপেক্ষায় রয়েছে। ইয়ার্ডের জায়গা খালি না থাকায় জাহাজ থেকে পণ্য নামাতে সমস্যা হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চট্টগ্রাম বন্দরের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, জট কমাতে ১৯টি অফডকে কনটেইনার সংরক্ষণের অনুমতি দেয়ার জন্য চিঠি দিয়েছিল চট্টগ্রাম বন্দর। ওই অনুমতি পেলে ১৯টি অফডকে ১৮ হাজার টিইইউএস কনটেইনার রাখা সম্ভব হবে। এছাড়া নারায়ণগঞ্জের মুক্তারপুরে অবস্থিত বেসরকারি কনটেইনার টার্মিনাল সামিট গ্রুপের এসএপিএলে শুল্কায়নের অনুমতি দিলে সেখানেও দুই থেকে আড়াই হাজার টিইইউএস কনটেইনার সংরক্ষণ করা সম্ভব হতো। এতে বন্দরের কনটেইনার জট কমে অর্ধেক হতো। কিন্তু এনবিআর বন্দরের প্রস্তাবে পুরোপুরি সায় দেয়নি। আংশিক সায় দিয়ে আগামী জুন পর্যন্ত নির্দিষ্ট ৩৮টি পণ্যের বাইরে আরও ৬টি পণ্যবাহী কনটেইনার অফডকে সংরক্ষণের অনুমতি দিয়েছে। পণ্যগুলো হচ্ছে- বীজ, সব ধরনের ফাইবার, ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের আমদানি ওষুধ প্রশাসনের অনুমোদিত ব্লক লিস্টের পণ্য, উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের আমদানি সুতা, কীটনাশক, উদ্ভিদনাশক ও ছত্রাকনাশক এবং টায়ার কর্ড। এনবিআরের এমন সিদ্ধান্তের ফলে সর্বোচ্চ ৬-৭ শতাংশ কনটেইনার অফডকে পাঠানো সম্ভব হবে।
কর্মকর্তারা আরও বলেন, বন্দরে গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর ১৫ থেকে ১৬ হাজার টিইইউএস কনটেইনার রয়েছে। যা বন্দরের জট সৃষ্টির অন্যতম কারণ। এগুলোর কারণে বন্দরের কমবেশি ৪০ শতাংশ জায়গা আটকা রয়েছে। এছাড়া বাণিজ্যিক পণ্যবাহী কনটেইনারের দখলে রয়েছে ইয়ার্ডের ২০-২২ শতাংশ জায়গা। এসব কনটেইনার দ্রুত সরিয়ে নিতে পারলে বন্দরের কার্যক্রমের গতি বাড়বে।