শনিবার, ০৩ জুন ২০২৩, ২০ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩০
আসাদ চৌধুরী।।
একাত্তরে ৯ মাসের রক্তস্নাত মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্ম হয়নি। স্বাধীনতা অর্জন করতে গিয়ে অসংখ্য বাঙালিকে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিতে হয়েছে। এখনও অনেক মুক্তিযোদ্ধা পঙ্গু হয়ে বেঁচে আছেন। শারীরিক পঙ্গুত্বের বিষয়টি আমরা চোখের সামনে দেখতে পাই। অনেকের চোখের সামনে স্বজনকে অত্যাচার করা হয়েছে, গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে, বাড়িঘর আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই স্বাধীনতা লাভের আনন্দ এখন আর ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।
আবার আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধের বিভীষিকাময় দিনগুলো দেখেছি, তারা পাঁচ দশক পরও চোখ বন্ধ করলেই সেই রোমহর্ষক স্মৃতি দেখতে পাই। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ঘুমন্ত বাঙালির ওপর নারকীয় হামলা চালিয়েছে, নির্বিচারে মানুষ হত্যা করেছে। এ রকম বর্বরতা ইতিহাসে বিরল। এ রকম দুর্বিষহ ঘটনার সাক্ষী হয়ে বেঁচে থাকাটা অত সহজ নয়। স্বজন হারানোর বেদনা কত কঠিন– তা যাঁর হারিয়েছে, তিনিই অনুধাবন করতে পারেন।
মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে ‘বারবারা’ নামে আমার একটি কবিতা রয়েছে। সেখান থেকে কয়েকটি লাইন উদ্ধৃত করছি– ‘তোমাদের কাগজে নিশ্চয়ই ইয়াহিয়া খাঁর ছবি ছাপা হয়-/ বিবেকের বোতামগুলো খুলে হৃদয় দিয়ে দেখো/ ওটা একটা জল্লাদের ছবি/…বারবারা এসো,/ রবিশঙ্করের সুরে সুরে মুমূর্ষু মানবতাকে গাই/ বিবেকের জংধরা দরোজায় প্রবল করাঘাত করি/ অন্যায়ের বিপুল হিমালয় দেখে এসে ক্রুদ্ধ হই, সংগঠিত হই/ জল্লাদের শানিত অস্ত্র/ সভ্যতার নির্মল পুষ্পকে আহত করার পূর্বে,/ দর্শন ও সাহিত্যকে হত্যা করার পূর্বে/ এসো বারবারা বজ্র হয়ে বিদ্ধ করি তাকে।’
পাঁচ দশক পরে হলেও গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি চাই। পাশাপাশি আমাদের চাওয়া– আর কোনো দেশে কিংবা সমাজে যেন এ ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনা না ঘটে। ’৭১-এর চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের অনেকের বিচার শেষ হয়েছে। বিচারের রায়ও কার্যকর হয়েছে কারও কারও। ধীরগতিতে হলেও বিচারকাজ চলমান। মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সম্মানিত করা হচ্ছে। তাঁদের ভাতা দেওয়া হচ্ছে। সরকারি অফিসে তাঁদের জন্য সংরক্ষিত আসন রয়েছে। চাকরি ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা বিশেষ সুবিধা পাচ্ছেন। মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন হচ্ছে। এসব কিন্তু কম নয়। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের যেভাবে সম্মানিত করা হচ্ছে, তা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। তবে যেসব মুক্তিযোদ্ধার নাম এখনও তালিকাভুক্ত করা হয়নি; মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাঁদের স্বীকৃতিটুকু দেওয়া দরকার।
মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে কাজ করেছি। কালা চান নামে একজন শিল্পী ছিল, বাঁশি বাজাত। একবার সে আবদার করল, আমাকে এক কাপ চা খাওয়াবে। আমি সম্মতি না দেওয়ায় আক্ষেপ করে বলল, ‘স্যার, এক কাপ চাও খাওয়াতে পারব না!’ তার জন্য এখন কষ্ট হয়। বলা চলে, না খেয়েই ছেলেটি মারা গেল। পরে যখন মুক্তিযোদ্ধা শিল্পীদের তালিকা হয়, কমিটিতে আমাকে রাখা হলো। কেন রাখা হলো জানি না। কালা চানের নামটি মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা নিয়ে অনেক কথা-কাটাকাটি হলো কমিটির বৈঠকে। আমাকে জিজ্ঞাসা করা হলো, কালা চানের বাবার নাম কী? আমি বললাম, জানি না। তারপর বলল, গ্রামের ঠিকানা কী? আমি বললাম, জানি না। আমি বললাম, কিছু জানার দরকার নেই, সে মারা গেছে। আমাদের কিছু করারও নেই। অন্তত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কাগজে তার স্বীকৃতিটা থাকুক। কালা চান চেষ্টা করলে ভারত যে তালিকা করেছিল, সেখানে তার নামটি থাকত। সেটাও হয়নি।
কলকাতায় আমি তখন গাফ্ফার ভাইয়ের (আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী) কল্যাণে ‘জয়বাংলা’ পত্রিকায় কাজ করি। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে আমার একটি গদ্য অনুষ্ঠান ছিল– মৃত্যুহীন প্রাণ। একদিন মুকুল ভাই (এম আর আখতার মুকুল) জয়বাংলা পত্রিকায় এসে বললেন– ওই মিয়া, চমক লাগিয়ে দিয়েছ। আমি বললাম, কী ব্যাপার। মুকুল ভাই বললেন, ‘প্রধানমন্ত্রী তোমার মৃত্যুহীন প্রাণ শুনেছেন, চালিয়ে যাও। থামবা না।’ আমি বললাম, ঠিক আছে। বেশি দিন চালানোর সুযোগ হয়নি। দেশ স্বাধীন হয়ে গেল। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে ‘মোদের গরব মোদের আশা’ নামে আমি আরেকটি সিরিজ করেছিলাম। এগুলো মুক্তিযুদ্ধের ৪ নম্বর দলিলে লেখা রয়েছে। ফটোকপি করে রাখার মতো ধৈর্য সে সময় আমার ছিল না।
কালা চানের মতো যাঁরা মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতিটুকু পাননি, তাঁদের ব্যাপারে সরকার নিশ্চয়ই ভাববে। আমি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মাসে ২০ হাজার টাকা পাচ্ছি। ১৯৬২ সালের পর আমাদের গ্রাম উলানিয়ায় বাড়ি ছিল না। গত বছর যখন বাড়ি বানানোর উদ্যোগ নিলাম তখন মুক্তিযোদ্ধা ভাই বললেন, সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের গৃহ নির্মাণের জন্য ৫-১০ লাখ টাকা ঋণ দিচ্ছে। ৩ লাখ টাকা এমনিই দিয়ে দেয়। আমি তখন ১০ লাখ টাকার জন্য আবেদন করলাম। বরিশাল জেলার মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নুরুন নবীর আন্তরিকতায় সোনালী ব্যাংক ঋণটি মঞ্জুর করে। নিজের কথা এ জন্য বললাম, মুক্তিযোদ্ধারা যে সম্মান পাচ্ছেন, তা কোনো অংশে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। কিন্তু সমস্যা অন্যখানে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় বিশ্বাস করেছিলাম– এ দেশে সাম্প্রদায়িকতা থাকবে না। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সবাই সমান মর্যাদা ও সম্মান নিয়ে বাঁচবে। বাংলাদেশে ইসলাম প্রচার করেছেন পীর সাহেবরা। অর্থাৎ মারফতি চিন্তাধারায় বিশ্বাসীরা। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের বাতাস আমাদের এখানে অন্যভাবে পড়ছে। ওয়াহাবি আন্দোলনটা অন্যভাবে রূপ নিতে যাচ্ছে। এগুলো অনেক জায়গায় দেখি তো। কাগজে পড়ি, দেখি। আমার মনে হয়, ধার্মিকতা ও ধর্মান্ধতা এক কথা নয়। সম্প্রতি পঞ্চগড়ে যে সহিংসতা ঘটে গেল, তা ভাবতেও কষ্ট লাগে। এসব দেখার জন্য আমরা মুক্তিযুদ্ধ করিনি। ওদিকে আমাদের দেশে সেক্যুলার ভাবনাটাই সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। তাঁরা মুসলিম, খ্রিষ্টান, ইহুদি দর্শন সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানেন না।
পাকিস্তানি শাসক চক্র আমাদের শোষণ-নির্যাতন করেছিল বলেই মুক্তির আশায় আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি। ৩০ লাখ শহীদ আর দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে আমরা বাংলাদেশ পেয়েছি। গত ৫২ বছরে আমাদের অনেক অর্জন আছে। পাশাপাশি অনেক বিষয়েই আমরা পিছিয়ে পড়েছি। আমি প্রায়ই বলি, এ দেশে পাসের হার বাড়লেও শিক্ষিতের হার বাড়েনি। এসব কথা শুনে কারও রাগ হতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা অস্বীকার কীভাবে করব? এ দেশে লাঠি ছাড়া রাজনীতি অচল। সব দলেই মাস্তানরা ঢুকেছে। তারাই জোর করে, অনেকটা ছিনতাই করে, ক্ষমতা নিয়ে নিচ্ছে। এই জন্য তো আমরা মরণপণ মুক্তিযদ্ধ করিনি!
এবারের স্বাধীনতা দিবসে আমার প্রত্যাশা– রাজনীতি দুর্বৃত্তায়নমুক্ত হোক। সব পেশার মানুষ প্রলোভনের ঊর্ধ্বে উঠে দায়িত্ব পালন করুক। বেকারত্ব সমস্যার সমাধান হোক। নিরাপত্তাহীনতা দূর হোক। কোনো সাম্প্রদায়িক হামলার পুনরাবৃত্তি যেন আর না হয়। সূত্র- সমকাল।
লেখক: কবি আসাদ চৌধুরী।