সোমবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২৪
Menu
Menu

বর্তমান প্রজন্ম: স্মার্টফোনের অপব্যবহার

Facebook
Twitter

আশুক আহমদ।।
আধুনিক প্রযুক্তি দিন দিন মানুষের জীবনযাত্রা ডিজিটালাইজড করে সহজ এবং আরামদায়ক করে দিচ্ছে। বিশ্বায়নের যুগে সারা বিশ্ব যেমন গ্লোবাল ভিলেজ, মুঠোফোনের বদৌলতে বিশ্ব তেমনই এখন হাতের মুঠোয়। প্রযুক্তির উৎকর্ষতার ফলে মুঠোফোন আরও আধুনিক ও স্মার্ট চেহারা নিয়ে আমাদের মধ্যে স্মার্টফোন নামে আবির্ভূত হয়েছে। মুঠোয় নিয়ে চলার জন্য হাতে উঠেছে স্মার্ট চেহারার মুঠোফোন। এখন স্মার্টফোনে আমরা কী না করতে পারি? সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষায় ফেসবুক, টুইটার, ইন্সটাগ্রাম, হোয়াটস অ্যাপ, ইমো, ভাইবার, জুম ইত্যাদি টাকা পয়সা লেনদেনে ডিজিটাল ব্যাংকিং সেবা থেকে শুরু করে, ব্যাকআপ বা তথ্য সংরক্ষণ, খেলাধুলা, টিভি, বিনোদন, চিঠিপত্র, কেনাকাটা, পরিবহন টিকেট, নিজের স্বাস্থ্যের খোঁজ খবর, চলাফেরায় জিপিএস রোড ম্যাপ, বাজারের ফর্দ, ভর্তি, ক্লাস-রুটিন, এলার্ম ইত্যাদি সবকিছুই হচ্ছে স্মার্টফোনে। দৈনন্দিন জীবনের শত শত কাজ এই স্মার্টফোন যন্ত্র দিয়ে সহজে অনায়াসেই করা যাচ্ছে। বর্তমান প্রযুক্তি নির্ভর বিশ্বে মানুষের দৈনন্দিন জীবন এখন অনেকটা স্মার্টফোন নির্ভর।

অনেকে স্মার্টফোনকে আধুনিকতার মাপকাঠি মনে করেন। এমনকি দেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও খুব কমই লোক পাওয়া যাবে যার হাতে একটি স্মার্টফোন নেই। যার স্মার্ট ফোন নেই তাকে আনস্মার্ট বিবেচনা করা হয়। বোতামওয়ালা সেই ফিচার ফোনগুলোর দিন ফুরিয়ে গেছে, এটা হাতে রাখতে ফোরজি’রা লজ্জাবোধ করে।

আমরা শুনি অনেক মা-বাবা গর্ব করে বলেন আমার ছেলে/মেয়ে অনেক মেধাবী, মোবাইলের ব্যাপার সে আমার চেয়েও ভালো বোঝে। আবার এ যুগের বাচ্চারা নাকি ফোন হাতে না দিলে খেতেই চায় না। ইউটিউবে ভিডিও খোঁজে বের করা কোন ব্যাপারই না। নাহ, এটা বিশেষভাবে বলার কিছু নয়, গর্বের কোনো ব্যাপার নয় বরং নিজের সন্তানের বিপদ আপনি নিজেই ডেকে আনছেন।

চতুর্থ প্রজন্মের জীবনধারা এখন অনেকটাই যান্ত্রিক বানিয়ে দিয়েছে এই স্মার্টফোন। নানা রকমের গেমস এর প্রতি তাদের আসক্তি বেড়ে গেছে। আগেকার দিনে বিকেলে মাঠে ময়দানে তরুণদের বিভিন্ন খেলায় ব্যস্ত দেখা যেত। এতে তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ হত, অনেক ধরনের রোগ থেকে মুক্ত থাকত। এখন আর সে দৃশ্য খুব একটা চোখে পড়ে না। এর জন্য স্মার্টফোনের পাশাপাশি খেলার মাঠের অপ্রতুলতাও দায়ী। আমরা অপরিকল্পিতভাবে শহরে এমনকি গ্রামেও ঘর-বাড়ি, রাস্তাঘাট এবং অন্যান্য অবকাঠামো তৈরি করার দরুন খোলা মাঠ পাওয়া যায় না। তাই খেলাধুলার সুযোগ নেই। এখনকার প্রজন্ম ভার্চুয়াল জগতে খেলাধুলা করে, ফলে তাদের শরীর চর্চার সুযোগ নেই।

স্মার্টফোন দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আত্মীয় স্বজনদের সাথে কথা বলা এবং ছবি দেখার সুযোগ থাকায় এখন সামাজিক ও আত্মীয়তার সম্পর্ক আস্তে আস্তে দুর্বল হচ্ছে।

আগে দল বেঁধে কোথাও ঘুরতে গেলে সেই জায়গার সৌন্দর্য, আপনজনের সান্নিধ্যই মুখ্য ছিলো। কিন্তু স্মার্টফোন যুগের ছেলে মেয়েরা এখন সে জায়গায় গিয়ে আগে সেলফি তোলে।

বাবা-মা সন্তানের খোঁজ-খবর নেবার জন্য, সন্তানের আবদার পূরণ করার জন্য সন্তানের হাতে তুলে দিচ্ছেন স্মার্টফোন। কিন্তু তারা বুঝতে পারছেন না এর ফলে আমাদের কোমলমতি, দূরন্ত শিশু-কিশোরদেরকে এই যন্ত্র দিয়ে ঠেলে দিচ্ছেন ঐন্দ্রজালিক এক জগতের দিকে।

এখন গুগল সার্চ করে, ইউটিউবের সাহায্যে পর্নো ভিডিও হাতের মুঠোয় নিয়ে ঘুরছে টিনেজাররা। নোংরা ছবি আর ভিডিও দেখার সহজ মাধ্যম স্মার্টফোন। আমাদের সমাজে ইভ টিজিং বা ধর্ষণের জন্য এটা বহুলাংশে দায়ী। পর্নোগ্রাফি সহজলভ্যতার কারণে শিশু থেকে অশীতিপর বৃদ্ধা কেউ রেহাই পাচ্ছেন না ধর্ষণের হাত থেকে।

স্মার্টফোনে হরেকরকম এপস দিয়ে মেয়েদের ছবি, ভিডিও এডিট করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করতে ব্যস্ত থাকে এক শ্রেণি।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিশেষকরে ফেসবুকের মাধ্যমে গুজব রটিয়ে, ফেইক আইডি দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে এ গেজেট ব্যবহার করা হচ্ছে।

প্রেম নামক ছলনার আশ্রয় নিয়ে আপত্তিকর ছবি বা ভিডিও সংগ্রহ করে তা পাবলিকলি প্রচার করে সংসারে ভাংগন ধরানো হচ্ছে বা মুক্তিপন আদায় করা হচ্ছে। পরকিয়া এখন সাধারণ ব্যাপার, পরিবারের সম্প্রীতি নষ্ট হয়ে প্রতিদিন পরিবার ভেঙে যাওয়ার খবর পাওয়া যায়।
সেলফি তোলার জন্য স্মার্টফোনের কদর খুব বেশি। প্রয়োজনে সেলফি তোলা কোন দোষের কাজ নয়। কিন্তু যখন দেখা যায় নামাজের সেলফি, কবর খনন করার বা খনন শেষ করে নিজে কবরে শুয়ে অথবা লাশ রাখার সেলফি, হজ্বে গিয়ে, রোগীর সাথে, বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ পজিশনে সেলফি ওঠায় তখন তাদের মানসিকতার লেভেল নিয়ে চিন্তা আসে। এছাড়াও নিজের সুন্দর মুখমণ্ডল কে বন্য প্রাণীর মতো ভেংচিয়ে সেলফি তোলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়।

এতক্ষণ চরিত্র ধ্বংসের নানানদিক দেখলাম। ব্যাপারটা এখানেই শেষ নয়, স্মার্টফোন চরিত্র ধ্বংসের সাথে সাথে ব্যবহারকারীর চোখ, ব্রেনসহ সারা শরীর নষ্ট করে হরেকরকম রোগের জন্ম দিয়ে অনুভুতিহীন পাপেটে পরিণত করে। স্মার্টফোনের সুইচ অন করার বিশ সেকেন্ডের মধ্যে নিকটবর্তী ওয়াইফাই, ব্লুটুথ ও মোবাইল ট্রান্সমিটার; এমনকি অন্য আরেকটা স্মার্টফোনকে বৈদ্যুতিক সঙ্কেতের মাধ্যমে জানান দেয়- ‘আমি এখানে আছি’। স্মার্টফোনের এসব নানাবিধ ইলেকট্রনিক সিগন্যাল মানুষের জন্য খুবই ক্ষতিকর।

সবকিছুরই ভালো এবং মন্দ দুই দিক থাকে। প্রযুক্তিরও খারাপ দিকের সাথে ভালো দিক আছে। প্রযুক্তি নির্ভর এই যুগে সন্তানকে প্রযুক্তির সদ্ব্যবহার শেখাতে হবে পাশাপাশি তার বাড়ন্ত শৈশব ও কৈশোরকে করতে হবে দূরন্ত ও প্রাণবন্ত। স্মার্টফোন তথা প্রযুক্তির ব্যবহার যেন সঠিক এবং ভাল কাজে লাগে সেদিকে অভিভাবকদের সচেতন হওয়াটা এখন সময়ের দাবি।

লেখক: প্রধান শিক্ষক, দক্ষিণভাগ এনসিএম উচ্চ বিদ্যালয়।
বড়লেখা, মৌলভীবাজার।

জনপ্রিয়