এ কে সরকার শাওন।।
বাংলাদেশে বর্ষার আবেদন বহুমুখী! বর্ষা রূপময়, কাব্যময়, প্রেমময় ও বিষাদময় ইত্যাদি। বর্ষা অতি আকর্ষণীয় ঋতু। প্রায় সব কবি-সাহিত্যিকের মনে সে স্থায়ী আসন পেতে রানির মতো বসে আছে। সেই মধ্যযুগ থেকে আজ পর্যন্ত বাংলা কবিতা, গানে, গজলে, কথা-কাব্যে, বর্ষা-বন্দনা অনেক হয়েছে। বর্ষা-বৃষ্টি-কবিতা-প্রেম-বিরহ-সংগীত একটির সাথে অপরটি সম্পর্কযুক্ত, যা অবিচ্ছেদ্য। বর্ষার ভাবনা থেকে অনেকেই কবি হয়েছেন। তাই এমন কোনো কবি পাওয়া কঠিন, যিনি বর্ষাকে কেন্দ্র করে দু’চার লাইন লেখেননি। আসলে বর্ষার রূপটা এমনই আকর্ষণীয় যে, সে কোনো মানুষকেই সহজে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়।
রিমঝিম ছন্দের জাদুকরী তালে কবি নজরুলের ‘বাদলের পরী’ বর্ষা আসে ধরাতলে ধরণিকে ভালোবেসে নতুন করে সাজাতে ও নতুন প্রাণ সঞ্চার করতে! মানব-মানবী, ফুল-পাখী-বৃক্ষ-তরু-লতা, চাতক-চাতকি, তৃষিত-প্রেমার্ত হৃদয়, নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর-দীঘি, মাঠ-ঘাট, মরু-প্রান্তর, মাছ-ঘাস সবই অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে এই বর্ষার জন্য!
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশেষভাবে জয়গান গেয়ে বর্ষাকে বরণ করেছেন গানে গানে।
‘এসো শ্যামল সুন্দর,
আনো তব তাপহরা তৃষাহরা সঙ্গসুধা
বিরহিণী চাহিয়া আছে আকাশে॥’
তিনি অন্যভাবেও বর্ষাকে বরণ করেছেন,
‘বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি।
শুষ্ক হৃদয় লয়ে আছে দাঁড়াইয়ে
ঊর্ধ্ব মুখে নরনারী॥’
অনন্ত ভালো লাগার প্রিয় বর্ষাকালকে ধরায় আসার আহ্বান জানিয়ে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন,
‘এসো হে সজল শ্যাম-ঘন দেয়া
বেণু-কুঞ্জ-ছায়ায় এসো তাল-তমাল বনে
এসো শ্যামল ফুটাইয়া যূথী কুন্দ নীপ কেয়া॥’
তিনি বর্ষায় তাঁর প্রিয়া অঞ্জনাকে কানে অর্জুন মঞ্জরি ও গলায় কদম ফুলের মালা পরে রেবা-নদীর তীরে অভিসারে আসতে মিনতি করেছেন,
‘স্নিগ্ধশ্যাম বেনীবর্ণ এসো মালবিকা/
অর্জুন মঞ্জুরী কর্ণে গলে নীপ মালিকা।’
গীষ্মের কাঠফাটা রোদে মানুষের যখন ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা, তখন গীতিকবি সলিল চৌধুরী বর্ষাকে চরম কাকুতি-মিনতি ও ধান মেপে দেওয়ার শর্তে আসতে অনুরোধ করে লিখেছেন,
‘আয় বৃষ্টি ঝেপে
ধান দিব মেপে!’
কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করে কবিতায় যে চিত্র তুলে ধরেছেন, তা এককথায় অসাধারণ! গ্রীষ্মের প্রকোপে চৌচির বন্ধ্যা মাটির জন্য কৃষকের কান্না শুনতে পেয়ে তিনি বৃষ্টি ও বর্ষার কাছে ‘বৃষ্টি এবং সাহসী পুরুষের জন্য প্রার্থনা’ কবিতায় নিম্নোক্ত প্রার্থনা করে গেছেন!
‘আমি সাহসী পুরুষের জন্য প্রার্থনা করেছি
বর্ণ এবং বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করেছি
শস্য এবং গাভীর জন্য প্রার্থনা করেছি
আমি ভূমি এবং কৃষকের জন্য প্রার্থনা করেছি।’
আল্লাহকে ডাকার মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি বর্ষা-বৃষ্টিকে ডেকেছেন মরহুম শিল্পী আব্বাস ঊদ্দিন তাঁর একটি কালজয়ী গানের মাধ্যমে। গানটির প্রথম দু’লাইন নিম্নরূপ-
‘বেলা দ্বি-প্রহর, ধু-ধু বালূচর
ধূপেতে কলিজা ফাটে পিয়াসে কাতর…’
মাঝখানের লাইনগুলোর সাথে ছোট-বড় সবাই পরিচিত। ছোটবেলায় দেখতাম, যখন বৃষ্টির জন্য সবখানে হাহাকার; তখন একদল নারী-পুরুষ-ছোকড়া বাড়ি বাড়ি গিয়ে শরীরে কাদা-জল মেখে সমস্বরে গাইছে-
‘আল্লাহ মেঘ দে, আল্লাহ মেঘ দে,
আল্লাহ মেঘ দে, পানি দে, ছায়া দেরে তুই
আল্লাহ মেঘ দে।’
কালজয়ী গানটি লিখেছেন শ্রীমান গিরেন চক্রবর্তী মতান্তরে জালালুদ্দিন!
বর্ষা আসার পর খুশিতে কবিগুরু চাঞ্চল্য প্রকাশ করে লিখেছেন,
‘হৃদয় আমার নাচে রে
আজিকে ময়ূরের মতো নাচে রে…’
ডোবা, নালা, পুকুর সেঁচার পর মাছদের দিন কাটে বহু কষ্টে। তাই ওরা সারাক্ষণ মনে-প্রাণে বর্ষাকে ডাকে। মাছেরা যারপরনাই খুশি হয় বর্ষার আগমনে। পুঁছ নেড়ে নেড়ে বর্ষাকে স্বাগত জানায়। যা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘জীবন স্মৃতি’ কবিতায় সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন-
‘মীনগণ হীন হয়ে ছিল সরোবরে,
এখন তাহারা সুখে জলক্রীড়া করে।’
বর্ষার প্রথম দিন রবি ঠাকুরের প্রকৃতি পর্বের যে গানটি শুনে হাজার হাজার প্রেমিক কদম ফুল হাতে নিয়ে প্রেয়সীকে ইনিয়ে-বিনিয়ে মিনমিনিয়ে নিচের গানটি শোনাতে যান; তাদের প্রতি আহ্বান রইলো লকডাউনে বাড়ি থেকে বের না হতে। একান্তই যদি কেউ বের হন, কদম ফুলটি ধরা হাতটি যেন গ্লাভস পরিহিত থাকে। আর মুখে থাকে জীবন সুরক্ষাকারী মেডিকেটেড মাস্ক! আর বলুন-
‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল করেছ দান/
আমি দিতে এসেছি শ্রাবণের গান।’
কেননা বর্ষাকে সবাই অসম্ভব ভালোবাসে। অঝরে বর্ষা ঝরা মানে প্রিয়ার চোখের কাজল ধোয়া জল, যা অবিরল ধারায় ঝরে পড়লে আমাদের বুকটা বিদীর্ণ হয়ে যায়। নদী-সাগর তার অশ্রুতে কালো হয়ে যায়। আকাশে মেঘের রং পরিবর্তন হলে আমাদের মন-মেজাজ পরিবর্তন হয়ে যায়। বর্ষা ভালো থাকুক। বর্ষায় ধুয়ে-মুছে যাক যাবতীয় রোগ-ব্যাধি। পৃথিবী সুস্থ হয়ে উঠুক তাড়াতাড়ি।