ভূঁইয়া কামাল, মুলাদী (বরিশাল)।।
বরিশালের মুলাদী উপজেলার গ্রাম-গঞ্জে সোনাইল নামেই বেশি পরিচিত। এক সময় গ্রামের পথে ঘাটে দেখা যেত অনেক সোনালু গাছ। আমাদের ঘরবাড়ির চারপাশেও ছিল অনেক গাছ। এখন খুঁজলে মাত্র হাতেগোনা কয়েকটি পাওয়া যাবে।
সোনার ঝুমকা নয়, সোনার সঙ্গে কোন মিল আছে কি না জানি না। তারপরও সোনাইল ফুল জয় করে আছে প্রকৃতি। নামটা তার সোনামাখা সোনাইল রয়ে গেছে। গ্রাম বাংলায় হোনাইল বা সোনালু নামে অধিক পরিচিত। এই গ্রীষ্মের দুপুরে ঝুমকা ফুলের মত সারি ঝুলে থাকে গাছ জুড়ে। দেখলে পরাণ ঝুড়িয়ে যায় পথিকের।
এ গাছের দিকে তাকালেই চোখ জুড়িয়ে যাবে থোকায় থোকায় ঝুলে থাকা সোনালু ফুলের বাহারে। কী অপরূপ শোভা! মন ছুঁয়ে যায় যে কারও। বিভিন্ন এলাকায় সোনালুর দোল দেখে মনে হয় এ যেন প্রকৃতির হলুদাভ উষ্ণ অভ্যর্থনা। সোনালু দেখতে যেমন সুন্দর তেমনি তার নামেও আছে বাহার।
শীতকালে সব পাতা ঝরার পর বসন্তে একেবারেই মৃতের মতো দাঁড়িয়ে থাকে গাছটি। গ্রীষ্মের শুরুতে দু-একটি কচিপাতার সঙ্গে ফুল ফুটতে শুরু করে। হলুদ সোনালি রঙের অসংখ্য ফুল সারা গাছজুড়ে ঝাড় লণ্ঠনের মতো ঝুলতে থাকে।
স্থানীয়ভাবে যে নামেই চেনেন না কেন, ইংরেজিতে সোনালুকে বলা হয় ‘গোল্ডেন শাওয়ার ট্রি’। বৈজ্ঞানিক নাম কেসিয়া ফিসটুলা (ঈধংংরধ ঋধংঃঁষধ), পরিবার খবমঁসড়হড়ংধব, এর ফল লম্বা লাঠির আকৃতির হয়ে থাকে যা বানরের বিশেষ খাবার হিসেবেও পরিচিত। শক্ত ফলের কারণে গাছের নাম হয়েছে বাঁদর লাঠি। এজন্য স্থানীয়ভাবে এটাকে বানরের লাঠি বা বান্দর লাঠি, সোনালু বা সোনাইল নামে ডাকা হয়। সাধারণত সোনাইল গাছ বা বৃক্ষ মধ্যম আকৃতির হয়ে থাকে। গাছের ফুলগুলো মঞ্জুরীতে জন্মায়। অনেকটা কানের ঝুমকা ফুলের মত। পাঁচটি পাপড়ি থাকে। ফুলের রঙ উজ্জ্বল হলুদ বর্ণের হয়ে থাকে। ফল লম্বা নলাকার।
ফুলটির আদিনিবাস পূর্ব এশিয়া। গাঢ় সবুজ রঙের পাতাগুলো যৌগিক, মসৃণ ও ডিম্বাকৃতির। ফুল এক থেকে দেড় ইঞ্চি পর্যন্ত চওড়া হয়। গ্রীষ্মে প্রকৃতিতে প্রাণের সজীবতা নিয়ে যেসব ফুল ফোটে, তার মধ্যে সোনালু উল্লেখযোগ্য। কিশোরীর কানের দুলের মতো বৈশাখী হাওয়ায় দুলতে থাকা থোকা থোকা ফুলের কারণে এ গাছ সহজে দৃষ্টি এড়ায় না কারও।
বৈশাখের খরতাপে পুড়ছে প্রকৃতি। এর মধ্যেই মুলাদী পৌরসভার ৪নং ওয়ার্ডের হাজ্বী বাড়ির শাহ আলম হাওলাদার (হাজী মিঠু) বাড়ির সামনে হলুদের পসরা সাজিয়ে বসেছে সোনালু। রাস্তার দুই পাশে থোকায় থোকায় হলুদ ফুলে দৃষ্টি কেড়ে নেয় পথিকের।
দখিন হওয়ার দোলুনীতে সোনাইন ফুল দুলতে দেখে সুপ্ত প্রাণ জেগে না ওঠে পারে না পথিকের। এই সময় গ্রামবাংলার অনেক কিশোরীর কানে ঝুমকোর মতো দুলতে দেখা যায় সোনাইল ফুল। গ্রীষ্মের উন্মাতাল উজ্জ্বল হলুদ বর্ণের সোনাইল ফুল যে কাউকে আকৃষ্ট করে। তাই বোধ করি ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘দখিন হাওয়া জাগো জাগো, জাগাও জাগাও জাগাও আমার সুপ্ত এ প্রাণ…’।
এক সসময় সোনাইল গাছ নেই এমন গ্রাম খুঁজে পাওয়া যেত না। বর্তমানে প্রাকৃতিক বন উজার করার কারণে এখন প্রায় দুর্ভল জাতের তালিকায় নাম ওঠাতে যাচ্ছে সোনাইল গাছ। প্রকৃতি যেন নতুন সাজে সাজতে শুরু করে। তার সঙ্গে মিল রেখে সোনাইল ছাড়াচ্ছে সোনার আলো। তবে শহুরে আধুনিক শিক্ষার্থীদের অনেকে চেনে-ই না এটার পরিচয়। অথচ এর রয়েছে অনেক ওষধি গুণ। সোনাইল ফলের মজ্জা, গাছের ছাল উৎকৃষ্ট জোলাপ, কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে ব্যাপকভাবে ব্যহৃত হয়। অন্যদিকে গ্যাসট্রিকের ব্যাথা, ক্ষুধামন্দায়, বাতের চিকিৎসায় এবং টনসিলের চিকিৎসায় এর ফল ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া সোনাইল গাছের পাতার রস বাত রোগ, ক্ষয় ও মেহ রোগের উপকারী হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কাঠ খুব একটা দামি নয় বলে কিংবা গাছটি খুব ধীরে বাড়ে বলেই কেউ আর তেমন উৎসাহ নিয়ে সোনালু গাছ রোপণ করেন না।
মুলাদী সরকারি কলেজের উদ্ভিদ বিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মোসাঃ তাছলিমা বেগম বলেন, সোনাইল ফুল গাছ হিসেবে প্রকৃতির একটি বড় অংশ দখল করে আছে। অথচ এর ওষধী গুণ সম্পর্কে তেমন কোন প্রচার পায়নি। এর ওষধী গুণ যা আমাদের অনেকেরই জানার বাইরে। কিন্তু এত সুন্দর এই জাতটি প্রকৃতি থেকে আস্তে আস্তে বিলিন হয়ে যাচ্ছে। একে রক্ষা করতে সকলের উদ্যোগ নিতে হবে।