আন্তর্জাতিক ডেস্ক।।
প্রতিবেশি চীনের সঙ্গে ভারতের সেনা জওয়ানদের রক্তক্ষয়ী সংঘাতের বদৌলতে বিশ্বের সবাই জেনে গেছে লাদাখে অবস্থিত গালওয়ান উপত্যকার নাম। ভারত নিয়ন্ত্রীত এই উপত্যকাটি অবস্থানগত দিক থেকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় এর দখল নিয়ে চীনের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরেই বিবাদ চলছে যার ফলশ্রুতিতে সম্প্রতি এই সংঘাতের সৃষ্টি হয়।
ভয়াবহ এই সংঘাতে গোলাগুলি না হলেও হাতাহাতি এবং পেরেকওলা লাঠির আঘাতে ভারত হারিয়েছে এক কর্নেলসহ ২০ সেনা। চীনেরও অন্তত ৪৩ জন হতাহত হয়েছে বলে দাবি করেছে ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম।
গুরুত্বপূর্ণ এই গালওয়ান উপত্যকতা সম্পর্কে অনেকে আগে শুনলেও অনেক লোকেরই হয়তো জানা নেই এই স্থানটি যে ব্যক্তির নামে নামকরন করা হয়েছে তার সম্পর্কে।
লাদাখের এই উপত্যকার নাম সোয়াশো বছর আগে রাখা হয়ে কিংবদন্তী মুসলিম পর্বতারোহী ও অভিযাত্রী গুলাম রসুল গালওয়ানের নামে।
সেই ঔপনিবেশিক আমলে কোনও ভৌগোলিক নিদর্শন – তা সে পর্বতশৃঙ্গই হোক বা উপত্যকা-গিরিখাত – নেটিভ বা দেশি অভিযাত্রীদের নামে নাম রাখার ঘটনা ছিল খুবই বিরল।
হিমালয়ান জার্নালের দীর্ঘদিনের সম্পাদক হরিশ কাপাডিয়ার কথায়, ‘ব্রিটিশ অভিযাত্রীদের নামে নামকরণ করাটাই ছিল তখনকার রেওয়াজ – গালওয়ান উপত্যকা ছাড়া আর কোথাও কোনো স্থানীয় বাসিন্দার কপালে এই সম্মান জুটেছে এমন একটি দৃষ্টান্তও আমার জানা নেই।’
লাদাখের ধূসর পাহাড় আর তুষারধবল শিখর দিয়ে ঘেরা রুক্ষ ও প্রশস্ত, পাথুরে এক ল্যান্ডস্কেপের মধ্যে দিয়ে তিরতির করে বয়ে চলেছে গালওয়ান নদী, যার উৎস কারাকোরামের গিরিকন্দরে। আকসাই চীন ও পূর্ব লাদাখের মধ্যে দিয়ে প্রায় আশি কিলোমিটার প্রবাহিত হয়ে এই প্রবাহ গিয়ে মিশেছে শিয়ক নদীতে যা আবার সিন্ধুর একটি গুরুত্বপূর্ণ উপনদী।
কাশ্মীরি ভাষায় ‘গালওয়ান’ শব্দের অর্থ হল – ডাকাত। গুলাম রসুল গালওয়ানের পিতামহ কারা গালওয়ান ছিলেন উনিশ শতকের কাশ্মীরে বিখ্যাত এক দস্যু – ধনীর সম্পদ লুটে গরিবের মধ্যে বিলিয়ে দেয়ার জন্য তার খ্যাতি ছিল রবিনহুডের মতো।
কাশ্মীরের মহারাজার শোয়ার ঘরে ঢুকে পড়ে তার গলাতেও কারা গালওয়ান ছুরি ধরেছিলেন বলে জনশ্র্রুতি আছে।
কিন্তু পরে রাজার সেনাদের পাতা ফাঁদে ধরা পড়েই কারার ফাঁসি হয় – আর তার পরিবারের সদস্যরা পালিয়ে যেতে বাধ্য হন লাদাখে। কিন্তু ততদিনে তাদের নামের সঙ্গে স্থায়ীভাবে যুক্ত হয়ে যায় গালওয়ান বা ডাকাত শব্দটি।
গুলাম রসুল গালওয়ানের জন্ম লাদাখের রাজধানী লেহ’তে, সম্ভবত ১৮৭৮ সাল নাগাদ। বিধবা মা তাকে বড় করে তুলছিলেন, কিন্তু চরম দারিদ্রের সঙ্গে যুঝতে মাত্র বারো-তেরো বছর বয়স থেকেই সে ব্রিটিশ ও ইউরোপীয় অভিযাত্রীদের সঙ্গে নানা অভিযানে সামিল হতে শুরু করে।
মাত্র বারো বছর বয়সে স্যার ফ্রান্সিস ইয়ংহাসব্যান্ডের দলে পোর্টার বা মালবাহক হিসেবে তার অভিযানের শুরু। পশ্চিমা অভিযাত্রীরা তখন ঘন ঘন তিব্বত, ইয়ারকান্ড (যা এখন চীনের শিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুর স্বশাসিত অঞ্চল), কারাকোরাম, পামির মালভূমি বা মধ্য এশিয়ার দিকে অভিযান পরিচালনা করছেন, কিশোর গুলাম রসুলও জুটে যেত তাদের সঙ্গে।
তবে তার জীবনের মোড় ঘুরে যায় ১৮৯২ সালে চার্লস মারে’র (সেভেন্থ আর্ল অব ডানমোর) সঙ্গে পামীর ও কাশগার পর্বত অভিমুখে এক অভিযানে বেরিয়ে।
লাদাখের বিখ্যাত ঐতিহাসিক আবদুল গণি শেখ লিখেছেন, ‘ওই দলটি লাদাখের এক দুর্গম অঞ্চলে উঁচু উঁচু পর্বতমালা আর খাড়া গিরিখাতের এক মাঝখানে পড়ে থমকে গিয়েছিল – যেখান থেকে বেরোনোর কোনও রাস্তা দেখা যাচ্ছিল না।’
‘গুলাম রসুল – তখন তার বয়স মাত্র চোদ্দ – নিজেই বেরিয়ে পড়ে সেই জটিল গোলকধাঁধার মধ্যে থেকে বেরোনোর পথ খুঁজতে। তারপর খাদের ভেতর দিয়ে সে একটা বেশ সহজ রাস্তা ঠিক খুঁজেও বের করে ফেলে, যার ফলে ওই অভিযান শেষ পর্যন্ত কোনও ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই সম্পন্ন হতে পেরেছিল।’
‘অভিযাত্রী দলের নেতা চার্লস মারে কিশোর গুলাম রসুলের প্রতিভায় এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে তিনি কলকল করে বয়ে যাওয়া যে জলধারাটির পাশ ঘেঁষে নতুন রাস্তাটির সন্ধান মেলে তার নামকরণই করে ফেলেন ‘গালওয়ান নালা’। সেই থেকেই গুলাম রসুল গালওয়ান লাদাখের শুধু ইতিহাস নয়, ভূগোলেরও অংশ হয়ে গেছেন।’
সামান্য মালবাহক ও টাট্টু ঘোড়ার চালক থেকে গুলাম রসুল গালওয়ান একদিন লেহ’তে নিযুক্ত ব্রিটিশ জয়েন্ট কমিশনারের ‘আকসকল’ বা প্রধান সহকারীর পদেও উন্নীত হয়েছিলেন। আর অভিযানে বেরিয়ে পড়াটা ছিল তার নেশা, অর্থকষ্ট মিটে যাওয়ার পরও জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি যে কত অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছেন বা পথপ্রদর্শন করেছেন তার কোনো হিসাব নেই।
মাত্র সাতচল্লিশ বছর বেঁচেছিলেন গুলাম রসুল গালওয়ান। আর নানা অভিযানের ফাঁকে ফাঁকেই ইংরেজিতে লিখে ফেলেছিলেন নিজের আত্মজীবনী, ‘সার্ভেন্ট অব সাহিবস’ বা ‘সাহেবদের ভৃত্য’। এক সময় এক বর্ণ ইংরেজি না-জেনেও কীভাবে তিনি ইংরেজিতে নিজের জীবনের স্মৃতিকথা লিখলেন, তারও এক মজার ইতিহাস আছে।
গুলাম রসুল গালওয়ান লাদাখি, উর্দু আর তুর্কী ভাষা বলতে পারতেন গড়গড় করে, জানতেন কাজ চালানোর মতো তিব্বতি আর কাশ্মীরিও। কিন্তু ইংরেজিতে অত সড়গড় ছিলেন না। মার্কিন অ্যাডভেঞ্চার রবার্ট ব্যারেটের সঙ্গে এক অভিযানে বেরিয়ে তার সিরিয়াস ইংরেজি চর্চার শুরু।
রবার্ট ব্যারেটের স্ত্রী ক্যাথরিনই তার আত্মজীবনীর সম্পাদনা করেছেন প্রায় এক যুগ ধরে। ক্যাথরিন ব্যারেট পরে জানিয়েছেন, ‘আমার স্বামীর সঙ্গে গুলাম রসুল গালওয়ানের যখন প্রথম দেখা হয় তখন তিনি বড়জোর দশ-বারোটা ইংরেজি শব্দ জানতেন। কিন্তু ইংরেজিতে লেখার ইচ্ছা ছিল প্রবল।’
‘রবার্ট ওর সঙ্গে সব সময় ধীরে ধীরে ইংরেজিতে কথা বলতেন যাতে ও শব্দগুলো শিখতে পারে। ওকে পড়ার জন্য দিয়েছিলেন একটা কিং জেমসের বাইবেল আর সপ্তদশ শতাব্দীর ট্র্যাভেলগ।’
‘গুলাম রসুল একটানা দশ বছর ধরে নিজের ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতেই আত্মজীবনীর নোট নিতেন, আর তারপর ডাকে সেগুলো আমার কাছে আমেরিকায় পাঠিয়ে দিতেন।’
প্রথমে পান্ডুলিপিগুলো আবার লেখার জন্য গুলাম রসুলের কাছে ফেরত পাঠাতে হলেও পরে আর তার দরকার হত না – তার নিজস্ব লেখার ভঙ্গীটাই বজায় রাখা হয়েছিল বলে জানিয়েছেন ক্যাথরিন ব্যারেট।
অবশেষে বিলেতের কেম্ব্রিজে প্রকাশনা সংস্থা ডাবলিউ হেফার অ্যান্ড সন্স থেকে ১৯২৩ সালে বের হয় সেই আত্মজীবনী : ‘সার্ভেন্ট অব সাহিবস – আ বুক টু রিড অ্যালাউড’।
এখন দিল্লির ‘দ্য ইকোনমিক টাইমস’ পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন রসুল বাইলে, পারিবারিক সম্পর্কে গুলাম রসুল গালওয়ান ছিলেন যার প্রপিতামহ।
সেই রসুল বাইলে বলছিলেন, ‘আজকের লাদাখে পয়সাকড়ি এসেছে পর্যটনের সুবাদে। কিন্তু একদিন লাদাখি যুবকদের জন্য পশ্চিমা অভিযাত্রীদের সঙ্গে বিপজ্জনক অভিযানে বেরিয়ে পড়া ছাড়া কোনো উপার্জনের রাস্তা ছিল না, আর সেখানে সবচেয়ে ঝুঁকির কাজগুলো তাদেরই করতে হত।’
‘আমার প্রপিতামহ গুলাম রসুল গুলওয়ানই সেই ধারাটার সূচনা করেন। ফ্রস্টবাইটে তার হাত ও পায়ের অনেকগুলো আঙুল পর্যন্ত খোয়াতে হয়েছিল – কিন্তু গালওয়ান উপত্যকার নামকরণের মধ্যে দিয়ে তার স্মৃতি আজও অমলিন রয়ে গেছে!’
রসুল বাইলে একদিন তার প্রপিতামহের নামে লাদাখে নিজের জমিতে একটা হোটেল চালু করার স্বপ্নও দেখেন। তবে তার চাচা এর মধ্যেই রাস্তার উল্টো দিকে চালু করে দিয়েছেন পর্যটকদের জন্য এক আধুনিক বিশ্রামাগার, ‘গালওয়ান গেস্ট হাউস’! সূত্র-বিবিসি।