ধর্ম ও জীবন।।
বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসে মানুষ দিশেহারা। বাংলাদেশেও প্রতিনিয়ত আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। দেশে করোনাভাইরাস শনাক্তের সংখ্যা ৫০ হাজার ছাড়িয়েছে। এতে আমাদেরকে আতঙ্কিত না হয়ে সবাইকে অনেক বেশি সচেতন হওয়া প্রয়োজন। প্রয়োজন ধৈর্যধারণ করার। কেননা করোনার আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষায় ধৈর্যের সঙ্গে পরিপূর্ণভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা ও ব্যক্তিগত সচেতনতার বিকল্প নেই। ইসলামের নির্দেশনাও এটি।
প্রতিদিন বিভিন্ন রোগব্যাধির কারণে বিশ্বব্যাপী হাজারও মানুষ পৃথিবী থেকে বিদায় নিচ্ছেন। আসলে সুস্থ থাকাটা মহান আল্লাহ পাকের এক বিশেষ নেয়ামত। আমরা যদি এ নেয়ামতের মুল্যায়ন না করি তাহলে আল্লাহ তাআলার হক আদায় থেকেও যেমন বঞ্চিত থাকব তেমনি বঞ্চিত থাকব বান্দার প্রাপ্য প্রদানের ক্ষেত্রেও।
স্বাস্থ্য যদি ভালো না থাকে তাহলে আমার কোনো কিছুরই যোগ্য হব না। চাই তা ইবাদতের ক্ষেত্রে হোক কিংবা বাহ্যিক কাজকর্মই হোক। তাই ইসলাম স্বাস্থ্যবিধি মেনে জীবন পরিচালনার ক্ষেত্রে এবং স্বাস্থ্যের প্রতি বিশেষভাবে দৃষ্টি রাখার বিষয়ে জোর তাগিদ প্রদান করে। আল্লাহ তাআলা মানুষকে তার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছেন। আর ইবাদত করার জন্য শারীরিক শক্তি আবশ্রক প্রয়োজন।
কেননা একজন সুস্থ্য মানুষই পারে সঠিকভাবে ইবাদত করতে। আমাদের স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে হলে শরীরের প্রতি যত্নবান হতে হবে। শরীরকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। বর্তমান করোনাভাইরাসের কারণে এ বিষয়ে আরও অধিক দৃষ্টি দেয়া জরুরি। স্বাস্থ্যবিধি মেনে আমরা যদি পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন থাকি তাহলে আল্লাহও আমাদেরকে ভালোবাসবেন। আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন-
‘নিশ্চয় আল্লাহ তাওবাকারিদের ভালোবাসেন এবং অধিক ভালোবাসেন পবিত্রতা অর্জনকারীদের।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ২২২)
এভাবে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার প্রতি গুরুত্বারোপ করে বিভিন্নস্থানে তার উম্মতকে নসিহত করেছেন। হাদিসে এসেছে-
হজরত আবু মালেক আশআরি রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অর্ধেক।’ (মুসলিম)
পবিত্র, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাকে ইসলামে যেভাবে গুরুত্ব দিয়েছে, অন্য কোনো ধর্মে তা দেয়া হয়নি। ইসলামে ব্যক্তির পরিচ্ছন্নতা থেকে শুরু করে ঘরের পরিচ্ছন্নতা, পরিবেশের পরিচ্ছন্নতা, চলাচলের রাস্তা-ঘাটের পরিচ্ছন্নতাসহ এমন কোনো দিক বাদ নেই যা নির্দেশ দেয়নি। এ পরিচ্ছন্নতার ওপর ইসলাম গুরুত্বারোপ কারণ কী?
এ নির্দেশনার মূল কারণ হলো-
আমরা যদি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকি তাহলে আমরা সুস্থ থাকব আর আমাদের স্বাস্থ্য ভালো থাকবে। বেশিরভাগ রোগ-ব্যাধি, মাহমারি আমাদের শরীরের যেমন আক্রমণ করতে পারবে না। তেমনি কোনো ভাইরাস আমাদের শরীরে দানা বাঁধতে পারবে না। কেননা অধিকাংশ রোগ-ব্যধি শরীরে আক্রমণের কারণই হলো অপরিচ্ছন্নতা।
এমন অনেক লোক আছে, যারা নিয়মিত গোসল করে না, ঠিকমত দাঁত পরিষ্কার করে না, ফলে শরীরে বিভিন্ন ধরনের ছোট ছোট রোগ দেখা দেয়, আর এ ছোট ছোট রোগগুলোই একদিন বড় আকার ধারণ করে।
যদিও সুস্থ থাকার জন্য আমাদের চেষ্টার কোনো অন্ত নেই। সুস্থ-সুন্দর জীবনযাপনের জন্য আমাদের কত আকুতি, কত পরিশ্রম, কত সাধনা। কিন্তু সত্যিকার অর্থে যে পথে সুস্থ থাকা যায় তার সঠিক নিয়ম অনুসরণ না করার কারণে আজ বিশ্বে এমনসব রোগ-ব্যাধি ছড়িয়ে পড়ছে, যেগুলো থেকে মুক্তি পাওয়ার কোনো উপায় এখন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সুস্থতার প্রতি মর্যাদা দিতে হাদিসের নির্দেশনা হলো-
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘হে আমার উম্মত! পাঁচটি সম্পদ হারানোর আগে তার মর্যাদা দাও। আর তাহলো-
* মারা যাওয়ার আগেই তোমার জীবনের প্রতি মুহূর্তকে কাজে লাগাও।
* বৃদ্ধ হওয়ার আগে যৌবনকে কাজে লাগাও।
* দারিদ্র্যের আগে সচ্ছলতার মূল্য দাও।
*অসুস্থতা আসার আগে সুস্থতাকে মর্যাদা দাও।
* ব্যস্ততার আগে অবসরকে মর্যাদা দাও।’ (মুসতাদরেকে হাকেম)
এ হাদিসে অসুস্থ হওয়ার আগে সুস্থতাকে মর্যাদার দেয়ার ব্যাপারে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়ে মুমিন মুসলমানকে উৎসাহিত করেছেন। তিনি বলেছেন- সুস্থতাকে কাজে লাগাও, স্বাস্থ্যকে রক্ষা কর।
প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এক সাহাবি সারাদিন রোজা রাখতেন আর সারারাত নফল নামাজ পড়তেন। আল্লাহর নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার ওই সাহাবিকে সুস্বাস্থ্য সম্পর্কে এ মর্মে নসিহত করেছেন-
‘হে আমার সাহাবি জেনে রেখ! নিশ্চয় তোমার উপর তোমার শরীরের হক রয়েছে।’ (বুখারি)
এ হাদিস থেকেও বুঝা যায়, রোজা রাখা আর নফল নামাজ পড়াই ইবাদত নয়, বরং নিজ নিজ সুস্বাস্থ্যেল প্রতি লক্ষ্য রাখাও ইবাদত। ইসলাম এমন কিছু করতে বলে না যার জন্য কোনো ব্যক্তিকে শারীরিক সমস্যায় পড়তে হবে।
আমরা যদি সব কিছু ভুলে গিয়ে কেবল দিন-রাত ইবাদত-বন্দেগিতে মগ্ন থাকি আর শরীরের প্রতি, ঘর-সংসারের প্রতি, স্ত্রী-সন্তানের প্রতি বেখেয়াল হয়ে যাই, তবে কি মহান আল্লাহ আমাদের প্রতি সন্তুষ্ট হবেন? কখনওই না বরং তিনি ঘর-সংসার প্রতিপালন থেকে শুরু করে ঘুমানো ও শিশু সন্তানদের সঙ্গে আদর-সোহাগ ও রসিকতাতেও ইবাদত হিসেবে গণ্য করেছেন। তার দেয়া স্বাস্থ্য ও সুস্থতাকে নেয়ামত হিসেবে দান করেছেন। কেননা এ স্বাস্থ্য ও সুস্থতা দিয়ে মানুষ একাগ্রচিত্তে মহান আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগিতে নিয়োজিত হবে।
আমরা যদি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি তাহলে আমরা সুস্থ থাকব। হাদিসও স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যাপারে জোর তাগিদ এসেছে-
– হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘অধিকাংশ মানুষ আল্লাহ পাকের দু’টি বিশেষ নেয়ামত সম্পর্কে খুবই অমনোযোগী। একটি হলো স্বাস্থ্য আর অপরটি হলো অবসর।’ (বুখারি ও তিরমিজি)
– রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও ইরশাদ করেছেন, ‘দুর্বল মুমিনের চেয়ে শক্তিশালী মুমিন উত্তম এবং আল্লাহর কাছে বেশি প্রিয়।’ (মুসলিম)
ইসলামের দৃষ্টিতে অসুস্থ হয়ে চিকিৎসা গ্রহণ করার চেয়ে সুস্থ অবস্থায় স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা উত্তম। বর্তমান মহামারি পরিস্থিতিতে সরকার ও দায়িত্বশীলদের পক্ষ থেকে বার বার আমাদেরকে বলা হচ্ছে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য কিন্তু আমরা ক’জন তা মেনে চলছি। হাদিসে এসেছে-
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘কেয়ামতের দিন বান্দাকে নেয়ামত সম্পর্কে সর্বপ্রথম যে প্রশ্নটি করা হবে তা হলো তার সুস্থতা সম্পর্কে। তাকে বলা হবে আমি কি তোমাকে শারীরিক সুস্থতা দিইনি?’ (তিরমিজি)
আবার রোগাক্রান্ত হলে শুধু আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করে বসে না থেকে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা নেয়ার তাগিদ দিয়েছে ইসলাম। কেননা, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে অসুস্থ হলে চিকিৎসা নিতেন এবং বলতেন-
‘হে আল্লাহর বান্দারা! তোমরা চিকিৎসা নাও, কেননা আল্লাহ তাআলা এমন কোনো রোগ সৃষ্টি করেননি যার প্রতিষেধক তিনি সৃষ্টি করেননি। তবে একটি রোগ আছে যার কোনো প্রতিষেধক নেই, তাহলো বার্ধক্য।’ (আবু দাউদ)
পরিশেষে এটাই বলব, বর্তমান পরিস্থিতিতে সুস্থ থাকতে এবং চিকিৎসা গ্রহণ করতে ইসলামের দিক-নির্দেশনা মেনে চলে নিজেকে সুস্থ রাখব এবং সরকার ও চিকিৎসক কর্তৃক ঘোষিত স্বাস্থ্যবিধি বিষয়ক নির্দেশনা মেনে চলবো। তবেই সম্ভব সুস্থ থাকা এবং সুস্বাস্থ্য লাভ করা।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে বর্তমান মহামারি করোনার উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পরিপূর্ণভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার তাওফিক দান করুন। আমিন।
মাহমুদ আহমদ, ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট।