শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ, ১৪৩১
অনলাইন ডেস্ক।।
সড়ক নির্মাণ আর বিদ্যুৎ খাতের ব্যয় সংকোচন করতে যুগোপযোগী প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন বরিশালের শিক্ষার্থী মোসলেহ উদ্দীন সাহান। তার উদ্ভাবিত ‘স্মার্ট সোলার হাইওয়ে অ্যান্ড পাওয়ার প্ল্যান্ট’ ব্যবহার করে একটি সড়ক থেকে তিন উপায়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। যার মাধ্যমে আধুনিক শহর চালু রাখা যাবে। সড়ক সংস্কারে বাড়বে না বাজেট। উল্টো দুই লেনের এক কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ ব্যয় কমে আসবে। এই সড়কের কোনো অংশ সংস্কারের দরকার হলে পুরো সড়ক সংস্কারের প্রয়োজন নেই। বরং ক্ষতিগ্রস্ত অংশটুকু মেরামত করলেই চলবে।
সাহানের উদ্ভাবিত প্রযুক্তি দেশে পরিচিতি না পেলেও স্থানীয় এবং জাতীয় পর্যায়ে পুরস্কার জিতে দেশের বাইরেও প্রদর্শিত হয়েছে। ২০১৮ সালের এপ্রিলে জাপানের সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি এজেন্সির আমন্ত্রণে সাকুরা সায়েন্স এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করেন সাহান। সেখানে নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানীরাও অংশ নেন।
মোসলেহ উদ্দীন সাহান বলেন, স্মার্ট সোলার হাইওয়ে অ্যান্ড পাওয়ার প্ল্যান্ট প্রযুক্তি জাপানের দুই কিলোমিটার সড়কে পাইলট প্রকল্প হিসেবে বাস্তবায়ন করার কথা রয়েছে। সুফল মিললে তারা বৃহৎ পরিসরে কাজ শুরু করবে বলে আমাকে জানানো হয়েছে।
তরুণ এই উদ্ভাবক বলেন, স্মার্ট সোলার হাইওয়ে অ্যান্ড পাওয়ার প্ল্যান্ট অগ্রসরমান পৃথিবীর জন্য।
মোসলেহ উদ্দীন সাহান বরিশাল নগরীর আমানতগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা হলেও বর্তমানে থাকেন সিটি করপোরেশনের ২০ নম্বর ওয়ার্ডের কলেজ এভিনিউয়ের ৫ নম্বর গলিতে। তার বাবা ডা. মোখলেসুর রহমান আগৈলঝাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার (স্যাকমো)। মা কামরুন্নাহার নূর গৃহিণী। আর বড় ভাই মেজবাহ উদ্দিন রায়হান একটি বেসরকারি কোম্পানিতে কাজ করেন।
২০১৮ সালে আগৈলঝাড়া উপজেলার গৈলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে এসএসসি এবং ২০২০ সালে সরকারি ব্রজমোহন (বিএম) কলেজের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে এইচএসসি পাস করেছেন। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সাহানের ইচ্ছা খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকৌশল বিজ্ঞানে অথবা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফার্মেসি বিভাগে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করা। আর সারাজীবন উদ্ভাবন নিয়ে কাজ করা।
এই প্রযুক্তি কেন দরকার? এমন প্রশ্নের জবাবে সাহান বলেন, স্বল্প পরিসর ব্যবহার করে অধিক সুবিধা নেওয়া হচ্ছে বড় চ্যালেঞ্জ। স্মার্ট সোলার হাইওয়ে পাওয়ার প্ল্যান্ট হচ্ছে এমন একটি প্রযুক্তি, যেখানে একটি সড়ক নির্মাণের মাধ্যমে বিদ্যুৎ ও হাইওয়ের সুবিধা নেওয়া সম্ভব।
তিনি বলেন, ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ খাতে বাজেট ধরা হয় ২১ হাজার ২১৪ কোটি টাকা। ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে এই বাজেট বৃদ্ধি পায় ২৬ হাজার ৫০২ কোটি টাকায় এবং ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে এই খাতে বাজেট আরও বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ২৮ হাজার ৫১ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রতি বছর এই খাতে বাজেট বাড়ছেই।
অন্যদিকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থায় সবাই সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করতে পারেন না। সাধারণত একটি বাড়িতে ১৫-২০ ওয়াটের একটি সৌর প্যানেল ব্যবহার করলে ব্যাটারি, কন্ট্রোলারসহ ২০-২৫ হাজার টাকা খরচ হয়ে যায়। যা সকলের পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়। কিন্তু সোলার হাইওয়ে নির্মাণ হলে ব্যক্তি পর্যায়ের খরচ হবে না। সেই সঙ্গে বছর বছর বাড়বে না বাজেট। একবার নির্মাণ করে নিলে তা কমপক্ষে ৬০ বছর স্থায়ী হবে। সোলার হাইওয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে, তা ব্যবহার করবে সকল জনগণ। এমনকি প্রয়োজনের অতিরিক্ত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডেও সংযুক্ত করা যাবে।
তরুণ এই প্রযুক্তিবিদ বলেন, স্মার্ট সোলার হাইওয়ে তিন উপায়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে। মানুষের হাঁটাচলায় ঘর্ষণ শক্তির মাধ্যমে, সূর্যের আলোর সাহায্যে সোলার সেল থেকে এবং গাড়ি চলাচলে সৃষ্ট চাপ শক্তিকে বিদ্যুৎ শক্তিতে রুপান্তরিত করবে। তিনটি প্রাকৃতিক শক্তিকে ন্যানো টেকনোলজি কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ শক্তিতে পরিণত করা হচ্ছে। এজন্য প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার সুযোগ নেই। তাছাড়া স্মার্ট সোলার হাইওয়ে অ্যান্ড পাওয়ার প্ল্যান্ট পরিবেশবান্ধব ও নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস। যতদিন সূর্যের আলো থাকবে এই সড়ক দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব।
সাধারণত পিচ, কয়লা ও বিটুমিন পুড়িয়ে সড়ক নির্মাণকালে কার্বনডাই অক্সাইড, কার্বন মনো অক্সাইডসহ বিভিন্ন ক্ষতিকারক গ্যাস উৎপন্ন হয়। যেগুলো আমাদের পৃথিবীর ওজন স্তরকে ধ্বংস করে। ওজন স্তরের কাজ হচ্ছে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি থেকে আমাদের রক্ষা করা। কিন্তু সেগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আর যদি জ্বালানির সঙ্গে সালফারের যোগসূত্র থাকে তাহলে এসিড বৃষ্টির সৃষ্টি হয়। এসব ক্ষতিকারক দিক থেকে একটি স্মার্ট সোলার হাইওয়ে অ্যান্ড পাওয়ার প্ল্যান্ট হতে পারে আদর্শ শক্তির উৎস।
মোসলেহ উদ্দিন সাহান বলেন, স্মার্ট সোলার হাইওয়ে অ্যান্ড পাওয়ার প্ল্যান্ট তৈরিতে রাস্তার সবার নিচে বালুর বা পাথরের কোনো স্তর লাগবে না। এই রাস্তার সবার নিচের স্তরে থাকবে পিজো, যার কাজ প্রেসারের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা। এরপর সোলার সেল, যার কাজ সূর্যের আলো থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা। এছাড়াও সোলার সেল তৈরির সময় তার সঙ্গেই ডায়োড থাকবে, যার মাধ্যমে মানুষের হাঁটাচলার সময় ঘর্ষণে যে ইলেকট্রনের সৃষ্টি হয় তাকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে। প্রশ্ন থাকতে পারে যে ঘর্ষণের মাধ্যমে যে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হবে তা মানুষকে বিদ্যুতায়িত করতে পারে। এ কারণে এখানে এমন টেকনোলজি ব্যবহার করা হবে যাতে মানুষ বিদ্যুতায়িত না হয়।
তিনি বলেন, পলি ক্রিস্টালিন ও পলি কার্বোনেট ব্যবহার করে বিশেষ ধরনের গ্লাস সড়কের ওপরে স্থাপন করা হবে। যার ফলে সড়কটিতে যানবাহন চলাচল উপযোগী হবে। এই গ্লাসের ওপর থেকে ৩০ মেট্রিক টন ভারবাহী যানবাহন অনায়াসে চলাচল করতে পারবে। পুরো প্রকল্পটি ন্যানো টেকনোলজি নির্ভর।
এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে বরিশাল-ঢাকা মহাসড়কের মতো দুই লেনের দুই কিলোমিটার রাস্তায় বছরে ছয় হাজার ৭৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। আর যে বিদ্যুৎ পাবো সেটা ডিসি বিদ্যুৎ। এটিকে বাসাবাড়ি, শিল্প কারখানায় ব্যবহারের জন্য ইনভার্টার ব্যবহার করে এসি করা হবে। এখান থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ পাওয়ার স্টেশনে যাবে, যেখানে স্টোরেজ ডিভাইসও থাকবে। ঝড়-বৃষ্টি হলে যাতে ব্যাকআপ দিতে পারে। আর এটির ভালো দিক হচ্ছে ন্যানো টেকনোলজির কারণে আকাশ মেঘলা থাকলেও বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। এই বিদ্যুৎ দিয়ে শহরে মেট্রোরেলও চালানো সম্ভব। ফলে এক সড়কের বিদ্যুৎ নানা কাজে ব্যবহার করা যাবে।
মূলত বিভিন্ন মাধ্যমে সড়ক ও বিদ্যুৎ বিভাগে লোকসানের প্রতিবেদন পড়ে প্রথম মোসলেহ উদ্দীন সাহানের চিন্তা আসে কীভাবে এই লোকসান খাত থেকে বের হওয়া যায়। এই চিন্তার সূত্র ধরে ২০১৬ সালে প্রথমে একটি ডায়াগ্রাম প্রস্তুত করেন স্মার্ট সোলার হাইওয়ে অ্যান্ড পাওয়ার প্ল্যান্টের। ১০ মার্চ শুরু হয় নির্মাণ। এক বছর বিভিন্ন গবেষণা, সংযোজন-বিয়োজন করে ২০১৭ সালের মার্চ মাসে পুরোপুরি প্রস্তুত হয় সোলার হাইওয়ে।
ওই বছরের এপ্রিলে মোসলেহ উদ্দীনের উদ্ভাবিত স্মার্ট সোলার হাইওয়ে অ্যান্ড পাওয়ার প্ল্যান্ট সৃজনশীল মেধা অন্বেষণে উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে প্রথম স্থান অর্জন করেন। একই বছর জাতীয় পর্যায়ে ‘বছরের সেরা মেধাবী’ নির্বাচিত হন। একই বছর অর্থাৎ ২০১৭ সালের ৩৮তম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সপ্তাহে দেশসেরা হয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমানের হাত থেকে পুরস্কার গ্রহণ করেন। ২০১৮ সালের এপ্রিলে জাপানের সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি এজেন্সির আমন্ত্রণে সাকুরা সায়েন্স এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করে। আর ২০১৯ সালে সৃজনশীল মেধা অন্বেষনে উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে প্রথম স্থান অর্জন করে জাতীয় পর্যায়ে বছরের সেরা মেধাবীর খেতাব অর্জন করেন।
মোসলেহ উদ্দিন সাহান বলেন, বর্তমানে এই প্রযুক্তির আরও আধুনিকায়নের চেষ্টা করা হচ্ছে। এর সঙ্গে অটো ট্রাফিক কন্ট্রোল সিস্টেম, ডাস্ট সেন্সর সিস্টেম যুক্ত করার কাজ করছি। স্মার্ট সোলার হাইওয়ে অ্যান্ড পাওয়ার প্ল্যান্ট প্রযুক্তি উদ্ভাবনে এখন পর্যন্ত ৭০ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে।
সরকারি ব্রজমোহন (বিএম) কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. মো. গোলাম কিবরিয়া বলেন, মোসলেহ উদ্দীন সাহানের উদ্ভাবন সর্ম্পকে আমি জানি। সে জাতীয় পর্যায়ে পুরস্কৃত হয়েছে। এই সংবাদ শুধু আমার কলেজের জন্য সুখবর নয় দেশবাসীর জন্য চমৎকার একটি সম্ভাবনার সংবাদ। তার এই উদ্ভাবনের জন্য আমাদের কলেজের ছাত্র থাকাকালে জাপান ভ্রমণ করেছে সাহান।
তিনি আরও বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি মোসলেহ উদ্দীন সাহান এই তরুণ বয়সে যে প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে তা আমাদের অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে। উদ্ভাবনের চিন্তা, মেধা এবং চর্চা অব্যাহত রাখলে তার মাধ্যমে জাতীয়ভাবে আমরা অনেক কিছু পাবো। মোসলেহ উদ্দীন সাহানের সাফল্য কামনা করেন অধ্যক্ষ গোলাম কিবরিয়া।
বরিশালের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) সোহেল মারুফ বলেন, উদ্ভাবন যদি ইউনিক হয় তাহলে সেই প্রযুক্তি সর্ম্পকে জেলা প্রশাসন থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দফতরে বিবেচনার জন্য পাঠানো হয়। সেখানে গৃহীত হলে পাইলট প্রকল্প হিসেবে গ্রহণ করা হয়। এতে প্রাথমিকভাবে সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত অনুদান দিয়ে থাকে সংশ্লিষ্ট দফতর। স্মার্ট সোলার হাইওয়ে অ্যান্ড পাওয়ার প্ল্যান্ট যদি ইউনিক উদ্ভাবন হয় তাহলে সরকার সর্বোচ্চ সহায়তা করবে। সূত্র-ঢাকা পোস্ট