শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ, ১৪৩১
রূপালী স্বাস্থ্য।।
সব মা-বাবাই চায় তার সন্তান বেড়ে উঠুক আদর্শ মানুষ হয়ে। এজন্য অনেক মা শিশুর যত্নে আশপাশের মানুষের পরামর্শ নেন। আর এতে করে সবার কাছ থেকে পেয়ে থাকেন পরস্পর বিরোধী পরামর্শ। যা ওই সন্তানের মায়ের জন্য হতে পারে বিভ্রান্তিকর। তাই আদরের সন্তানের শরীরিক গঠন ও মেধা বিকাশে করণীয় সম্পর্কে বিস্তারিত পরামর্শ দিয়েছেন বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (শিশু বিভাগ) এর সাবেক সহকারী অধ্যাপক ডাঃ মো: আলী হাসান।
তিনি বলেন, জন্মের পর শূন্য থেকে ২৮ দিন পর্যন্ত, বলা হয় নবজাতক। একজন নারী গর্ভাবস্থায় থাকে, তখন থেকে নবজাতকের পরিচর্যা শুরু হয়। গর্ভবতী মা সঠিক পুষ্টি পাচ্ছে কি না দেখতে হবে। কারণ, এই পুষ্টি বাচ্চার শরীরের ওপর নির্ভর করবে। সেই মাকে আপনি একটি শান্ত পরিবেশ দিচ্ছেন কি না দেখতে হবে। কারণ, মা যদি চাপযুক্ত জীবনযাপন করে, সেই প্রভাবটা তার পেটে যে বাচ্চাটা রয়েছে তার ওপর পড়বে।
পরেরটা হচ্ছে শারীরিক ও মানসিকভাবে শিশুর বেড়ে ওঠা। মানসিক বিকাশ বলতে, যে বয়সে যেরকম দক্ষ হয়ে ওঠার কথা সেটা হতে পারছে কি না। মাতৃগর্ভে থাকাকালীন সময় কোন সমস্যা হয়েছে কি না। যদি সে জন্মই নেয় সমস্যা নিয়ে তাহলে জন্মের পর আপনি যা-ই করেন কাজ হবে না। তাই বাচ্চার মেধা বিকাশ দুটি পর্যায়ে হয়ে থাকে। যদি মায়ের জরায়ু সুস্থ থাকে সেটা। আরেকটা হচ্ছে জন্মের পরের সঠিক পরিচর্যা। দেখা গেল মায়ের জরায়ুতে টিউমার আছে, ওটা যায়গা নিয়ে রেখেছে ব্রেইন বেড়ে উঠতে পারলো না। তাহলে জন্মের পর শত চেষ্টা করেও মেধা বিকাশে খুব বেশি ফল হবে না।
ডাঃ মো: আলী হাসান বলেন, গর্ভবতী নারীকে অন্তত চারটি চেকআপ করতে হবে। চারটি চেকআপ করে আপনাকে দেখতে হবে পেটের মধ্যে বাচ্চার কোনো সমস্যা হলো কি না। বাচ্চা ঠিকমতো নড়াচড়া করছে কি না। বাচ্চার অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ঠিকমতো তৈরি হয়েছে কি না। গর্ভাবস্থায় মায়ের ডায়াবেটিস তৈরি হলো কি না, অথবা তার উচ্চ রক্তচাপ তৈরি হলো কি না, অথবা তার খিচুনি জনিত কোনো রোগ তৈরি হলো কি না। কারণ, এই জিনিসগুলো পেটে যে বাচ্চাটা রয়েছে, তার ওপর প্রভাব ফেলে। এছাড়া তার জরায়ুতে টিউমার আছে কি না সেটাও ধরা পড়বে।
মা কিভাবে শিশুর কেয়ার নিচ্ছে, কিভাবে খাওয়াচ্ছে, কিভাবে আচরণ করছে, কিভাবে কথা বলছে। এর ওপর নির্ভর করে কিন্তু বাচ্চা শিক্ষা পাচ্ছে জানিয়ে এই চিকিৎসক বলেন, আরেকটু বড় হলে ফ্যামিলি মেম্বাররা কিভাবে বাচ্চার সঙ্গে সাপোর্ট দিচ্ছে। যেমন বাংলা ভাষা শুনতে শুনতে শিশু বাংলা শিখছে, এই যে শুনতে শুনতে শেখার বয়সটা- এসময় তার সঙ্গে আচরণ, কথাবার্তা, মা এবং ফ্যামিলির অন্য মেম্বারদের সঠিক সাপোর্ট দিতে হবে।
তিনি জানান, শিশুর কিছুটা ডেভেলপমেন্ট হওয়া, অর্থাৎ শারীরিকভাবে কিছু কাজ করতে পারা। ৩ মাস বয়সে হাতটা সোজা করতে পারা, ৬ মাসে বসতে পারা, ৯ মাসে হামাগুড়ি, ১০ মাসে কিছু সাপোর্ট পেলে দাঁড়াতে পারবে। এর সাথে আরো বৃদ্ধি হলে সে কিছু ধরতে পারবে। ১০ মাস বয়সে সে উল্টাতে পারবে বইয়ের পাতা তবে ৩/৪ টা একসাথে। কিন্তু ১২ মাস বয়সে একটি পাতা আলাদা করে উল্টাতে পারবে। আর ৬/৭ মাস বয়সে কিছু শব্দ উচ্চারণ করতে পারে। এ বিষয়ে নজর রাখার পরামর্শ দেন তিনি।
ডাঃ মো: আলী হাসান জানান, ১২/১৩ মাস বয়সে কিছু ছোট ছোট শব্দ বলতে পারে, যেমন মা-বাবা। দুই বছর বয়সে একটি ছোট বাক্য বলতে পারে, যেমন- মাম খাবো, ভাত খাবো, এদিকে আসো। এগুলো নির্ভর করবে তাকে কিভাবে ইনফরমেশন দেয়া হচ্ছে তার ওপর। তার সঙ্গে যদি কেউ কথাই না বলে তাহলে তো সে শিখবে না। অনেক দাদা-দাদী বাচ্চার সঙ্গে কথা বলছে ‘ও’ কিছুই বুঝতেছে না। আমরা হয়তো মনে করি খামাখা কথা বলে লাভ কি! অথচ এই কথা বলা অনেক জরুরী। এভাবে একটু একটু কথা ওর মেমোরীতে যাচ্ছে, সেখান থেকেই সে শিখছে।
দুই ভাবে মেধার বিকাশ হয়ে থাকে জানিয়ে তিনি বলেন, একটা হলো জন্মগতভাবেই মেধা নিয়ে আসছে, আরেকটা হলো উপযুক্ত পরিবেশে বসবাস করার কারণে মেধার বিকাশ। আবার যদি দেখা যায় ভাষাগত দিক বা কাজের দিক থেকে নিম্ন পর্যায়ের কর্মকাণ্ড দেখেই বড় হচ্ছে তার একটা প্রভাব কিন্তু পড়ে। অর্থাৎ কত ইনফরমেশন সে পাচ্ছে। এরপর পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়া। কেউ মিলতে পারে না। আবার কোন কোন শিশু গিয়েই মিলে যায়। এগুলো মা থেকে বাবা থেকে, পরিবার থেকে, স্কুল থেকে আসে। সেখানে অনেক পরিবারের বাচ্চা আসে, সেখান থেকেও শেখে।
শিশুর খাবর নিয়ে মায়ের উৎকন্ঠা নিয়ে এই শিশু বিশেষজ্ঞ বলেন, কেউ কেউ চিন্তা করেন, বুকের দুধ তারা খাওয়াবে যারা দুধ কিনতে পারেন না। প্রতিবেশীর শিশুকে কোন কোম্পানীর দুধ খাওয়ালো, তার চেয়ে ভালো কোম্পানীর বা দামের দুধ খাওয়ানোর চিন্তা করে। এ জন্য আমাদের চিকিৎসকদেরও কিছুটা দায় আছে। কারণ আমরা মায়েদের বুঝাতে পারি না। আবার কেউ কেউ কোম্পানীর সুবিধা পেতে আলাদা দুধ খাওয়ানোর সাজেস্ট করেন। এছাড়াও মায়েরা কিছুটা বাইরে থেকে ভুল তথ্য পেয়ে থাকেন। তারা যেমন কোচিৎ সেন্টার বা কিন্ডার গার্টেন এ যখন যার, তখর এক যায়গায় জড়ো হয়ে একজন থেকে আরেকজন মিস ইনফরমেশন পেয়ে থাকেন। মূলত যেসব মা ইচ্ছা করেন বুকের দুধ খাওয়াবেন, তাদের প্রাকৃতিকভাবেই দুধ আসবে। যদি আগেই নেগেটিভ চিন্তা করেন যে, দুধ না আসলে গুড়ো দুধ খাওয়াবো তাহলে তো দুধ আসবে না।
তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, অনেক সময় মা বুঝতেই পারে না বাচ্চা দুধ পাচ্ছে, না পাচ্ছে না। যদি বাচ্চা দিনে ৬/৭ বার প্রস্রাব করে তাহলে বুঝতে হবে দুধ পাচ্ছে। এখন ১৮ বার প্রস্রাব করলেও মা বলছে বাচ্চা দুধ পায় না। চিকিৎসকরা যদি প্রশ্ন করেন, কীভাবে বুঝলেন দুধ পায় না? মায়েরা বলে থাকেন ‘বাচ্চা কান্নাকাটি করে’। বাচ্চা কান্নাকাটি করলেই দুধ পাচ্ছে না এটা মনে করার কারণ নেই। তার তো পেট ব্যাথাও করতে পারে। তবে বাচ্চার খাবার যেহেতু মায়ের কাছ থেকেই আসে, তাই মাকে কিন্তু পর্যাপ্ত খাবার খেতে হবে।