শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ, ১৪৩১
জাকিরুল আহসান।।
ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর, লেফটেন্যান্ট কাইয়ুম, লেফটেন্যান্ট আউয়াল, সঙ্গে আরও ৫০ জনের মতো মুক্তিযোদ্ধা। ১০ ডিসেম্বর অবস্থান নেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের পশ্চিমে বারঘরিয়া এলাকায়। ১৪ ডিসেম্বর ভোরে মাত্র ২০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে বারঘরিয়া এলাকা থেকে ৩/৪ টি দেশি নৌকায় রেহাইচর এলাকা থেকে মহানন্দা নদী অতিক্রম করেন। উত্তর দিক থেকে একটি একটি করে শত্রু অবস্থানের দখল নিতে থাকেন। এভাবে জয় যখন প্রায় সুনিশ্চিত তখনই ঘটে বিপর্যয়। হঠাৎ ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্সের ৮/১০ জন সৈনিক দৌড়ে চর এলাকায় এসে যোগ দেয়। শুরু হয় পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিবর্ষন। জীবনের পরোয়া না করে এগিয়ে যান ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর। মুখোমুখি সংঘর্ষে বাংকার চার্জে শত্রুর বুলেট এসে বিদ্ধ হয় তার কপালে। শহীদ হন জাহাঙ্গীর।
জন্ম ও শিক্ষাজীবন: মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর ১৯৪৯ সালের ৭ মার্চ বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ উপজেলার রহিমগঞ্জ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা আব্দুল মোতালেব হাওলাদার ছিলেন কৃষক এবং মা সাফিয়া বেগম ছিলেন গৃহিণী। মহিউদ্দিনরা তিন বোন তিন ভাই। দাদা আব্দুর রহিম হাওলাদার ছিলেন প্রতাপশালী ব্যক্তি। পিতার আর্থিক দৈন্যতার কারণে মাত্র সাড়ে তিন বছর বয়সে মামার বাড়ি মুলাদি উপজেলার পাতারচর গ্রামে যান জাহাঙ্গীর। পাতারচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১৯৫৩ সালে তার শিক্ষাজীবনের সূচনা হয়। মুলাদি মাহমুদ জান পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৬৪ সালে বিজ্ঞান বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। ১৯৬৬ তে তিনি বরিশাল বি.এম (ব্রজমোহন) কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন।
মিলিটারি একাডেমীতে যোগদান: উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর বিমানবাহিনীতে যোগদানের চেষ্টা করেন, কিন্তু চোখের অসুবিধা থাকায় ব্যর্থ হন। ১৯৬৭ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান বিভাগে অধ্যয়নরত অবস্থায়ই পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমীতে ক্যাডেট হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৮ সালের ২ জুন তিনি ইঞ্জিনিয়ার্স কোরে কমিশন লাভ করেন। সেনাবাহিনীতে তার নম্বর ছিল (চঝঝ-১০৪৩৯)। তিনি মিলিটারি কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিং, রিসালপুর থেকে অফিসার বেসিক কোর্স-২৯ এবং ইনফ্যান্ট্রি স্কুল অব ট্যাকটিক্স থেকে অফিসার উইপন কোর্স সম্পন্ন করেন। সর্বশেষ ১৯৬৯ সালে আগস্ট মাসের শেষের দিকে এক মাসের ছুটিতে দেশে ফেরেন।
মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা: ১৯৭১-এ স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় তিনি পাকিস্তানে ১৭৩ নম্বর ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যাটেলিয়ানে ‘পাকিস্তানের চীন সংযোগকারী মহাসড়ক’ নির্মাণে কর্তব্যরত ছিলেন। দেশের স্বাধীনতার জন্য পাকিস্তানের দুর্গম এলাকা অতিক্রম করে সঙ্গে মাত্র একটি পিস্তল নিয়ে ছুটে এসেছিলেন তিনি। ১০ জুন তিনি কয়েকদিনের ছুটি নেন এবং ফিরে পশ্চিম পাকিস্তানের রিসালপুর যান। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাকিস্তানি সেনা ও সীমান্তরক্ষীদের দৃষ্টি এড়িয়ে শিয়ালকোট সীমান্ত দিয়ে ভারতীয় এলাকায় প্রবেশ করেন।
প্রথমেই গেলেন নিকটবর্তী বিএসএফের ব্যাটালিয়ন হেড কোয়ার্টারে৷ সেখান থেকে দিল্লি, এরপর কলকাতা৷ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে চারজন বাঙালি সামরিক অফিসার পালিয়ে এসেছেন শুনে বাঙালি, মুক্তিবাহিনী ও বাঙালি শরণার্থীদের প্রাণে বিপুল উৎসাহ জাগল৷ মুক্তিযুদ্ধের চিফ কমান্ডার কর্নেল ওসমানী যুদ্ধক্ষেত্র থেকে কলকাতায় এলেন এই পাঁচ বীরকে অভ্যর্থনা দিতে৷ ভারত হতে পরে জাহাঙ্গীর বাংলাদেশের সীমান্তে পৌঁছেন। তবে পাকিস্তানে আটকে পড়া আরো তিনজন অফিসারসহ তিনি পালিয়ে যান ও ৩ জুলাই পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলার মেহেদিপুরে মুক্তিবাহিনীর ৭নং সেক্টরে সাব সেক্টর কমান্ডার হিসাবে যোগ দেন। তিনি সেক্টর কমান্ডার মেজর নাজমুল হকের অধীনে যুদ্ধ করেন।
রণাঙ্গনে অসাধারণ কৃতিত্ব দেখানোর কারণে তাকে রাজশাহীর চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহর দখলের দায়িত্ব দেয়া হয়। শহরটি দখলের জন্য সেক্টর কমান্ডার এ.এন.এম. নূরুজ্জামান তিনটি দল গঠন করেন। প্রথম দলের নেতৃত্ব মুক্তিযোদ্ধা গিয়াস, দ্বিতীয় দলের মুক্তিযোদ্ধা রশিদ এবং তৃতীয় দলের দায়িত্ব পান মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর। ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর আনুমানিক ৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে চাঁপাইনবাবগঞ্জের বারঘরিয়ায় অবস্থান নেন তিনি। ১১ ডিসেম্বর সেখানে ভারতীয় বাহিনীর গোলন্দাজ বাহিনীর গোলাবর্ষণ করার কথা ছিল। কিন্তু সেটি হয়নি। ১২ ও ১৩ ডিসেম্বর একাধিকবার ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর। পরে তিনি সিদ্ধান্ত নেন ভারতীয় বাহিনীর সহযোগিতা ছাড়াই শত্রুদের অবস্থানে আক্রমণ করবেন এবং তিনি সেটিই করেন। স্বাধীনতার ঊষালগ্নে বিজয় সুনিশ্চিত করেই তিনি শহীদ হয়েছিলেন।
সমাধি: ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের মৃতদেহ চাপাইনবাবগঞ্জ জেলার ঐতিহাসিক সোনা মসজিদ প্রাঙ্গণে নেয়া হয়। অসংখ্য স্বাধীনতা প্রেমিক জনগণ, ভক্ত মুক্তিযোদ্ধা, অগণিত মা-বোনের নয়ন জলের আশীর্বাদে সিক্ত করে তাকে সেখানে সমাহিত করা হয়।
পুরস্কার ও সম্মাননা: বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে চরম সাহসিকতা আর অসামান্য বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ যে সাতজন বীরকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সামরিক সম্মান “বীরশ্রেষ্ঠ” উপাধিতে ভূষিত করা হয় তাদের মধ্যে অন্যতম মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর। বরিশালে পরিবার ও গ্রামবাসীর ইচ্ছে অনুসারে তার ইউনিয়নের নাম ‘আগরপুর’ পরিবর্তন করে ‘মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর’ ইউনিয়ন করা হয়েছে৷ স্বরূপনগরে বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর কলেজের নাম তার নাম অনুসারে রাখা হয়েছে। ঝালকাঠি জেলা স্টেডিয়ামের নাম এই বীরশ্রেষ্ঠের নামে নামকরণ করা হয়। মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীরের স্মরণে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এর প্রধান ফটকের নামকরণ করা হয়েছে বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ জাহাঙ্গীর গেট। আগামী প্রজন্মকে বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপটেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সম্পর্কে জানাতে বরিশালের প্লানেট ওয়ার্ল্ড শিশু পার্কে তার স্মৃতি ফলক তৈরি করা হয়।
বরিশালে বাড়ি ও জাদুঘর: বীরশ্রেষ্ঠদের স্মৃতি রক্ষা প্রকল্পের আওতায় বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিনের গ্রাম রহিমগঞ্জে তার পরিবারের দান করা ৩০ শতাংশ জমির ওপর গড়ে তোলা হয় “বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর”। এটা জেলা পরিষদের তত্ত্বাবধানে ৬৭ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়। স্মৃতি জাদুঘরে বিভিন্ন সময়ে বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মহিউদ্দিনের পরিবারকে দেওয়া সরকারি বেসরকারি পদকের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধসহ নানা বিষয়ের চার হাজার বই, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নানা পোস্টার, সাময়িকী ও পত্রপত্রিকা সংরক্ষিত রয়েছে। ভাইয়ের স্মৃতিকে আগলে রাখতে ‘বীর ফাউন্ডেশন’ নামে ব্যক্তিগত সংগঠনের মাধ্যমে প্রতিবছর মেধাবী শিক্ষার্থীদের অনুদান দিয়ে যাচ্ছেন বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের একমাত্র ছোট ভাই মঞ্জুর আহম্মেদ বাচ্চু। আর তাতে সহযোগীতা করছেন দুই বোন রাহানুর ও খালেদা।