শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ, ১৪৩১
ভূঁইয়া কামাল মুলাদী (বরিশাল)।।
বরিশালের মুলাদী পৌরসভার ৩নং ওয়ার্ডের তেরচর গ্রামে ঐতিহ্যবাহী পরিবার খান (মৃধা) বাড়ির সামনে কাচারি ঘরটি শত বছরের সাক্ষী হয়ে আজো দাঁড়িয়ে রয়েছে। এক সময় কাচারি ঘর ছিল গ্রাম বাংলার অবস্থাসম্পন্ন গৃহস্থের আভিজাত্যের প্রতীক। টিনের ছাউনি আর কাঠের কারুকাজ করা থাকত কাচারি ঘর। এখানে আলোচনা, শালিস বৈঠক, আর গল্প আড্ডার আসর বসত। বর্ষাকালে কাচারি ঘরে বসে পুঁথিপাঠ শুনে মুগ্ধ হতেন শ্রোতাগণ। এ ঘর ছিলো গ্রাম বাংলার ইতিহাস ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও সংস্কৃতির একটি অংশ। কালের বিবর্তনে আজ কাচারি ঘর বাঙালির সংস্কৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। গেস্টরুম বা ড্রয়িং রুম আদী ভার্সন কাচারি ঘর এখন আর গ্রামীণ জনপদেও দেখা যায় না।
মূল বাড়ির একটু বাহিরে আলাদা খোলামেলা ঘর। অতিথি, পথচারি কিংবা সাক্ষাতপ্রার্থীরা এই ঘরে এসেই বসতো। প্রয়োজনে এক-দুইদিন রাত যাপনেরও ব্যবস্থা থাকতো এ ঘরে। বর্ষা মৌসুমে গ্রামের লোকজনদের উপস্থিতিতে কাচারি ঘরে বসতো পুঁথিপাঠ। পথচারিরা ক্ষণিকের জন্য এই কাচারি ঘরে বিশ্রাম নিতেন। বিপদে পরলে রাতযাপনের ব্যবস্থা থাকতো কাচারি ঘরে। বাড়ির ভিতর থেকে খাবার পাঠানো হতো কাচারি ঘরের অতিথির জন্য। আবাসিক গৃহশিক্ষকের (লজিং মাস্টার) থাকার ব্যবস্থা থাকতো কাচারি ঘরেই। এ বাড়ির কাচারি ঘর সকাল বেলা মক্তব হিসেবেও ব্যবহৃত হতো। জমিদারী প্রথার সময়ও খাজনা আদায় করা হতো এ কাচারি ঘরে বসে।
তেমনি শত বছরের একটি কাচারি ঘরের সন্ধান মিলেছে মুলাদী পৌরসভার ৩নং ওয়ার্ডে তেরচর গ্রামের খান বাড়ি। পারিবারিক সূত্রে জানাযায়, কাচারি ঘরটি মূলত ১৯০৭ সালে প্রতিষ্ঠা করেন আলী আহম্মেদ খান। এ বাড়ির সন্তান ও নাতিরা বাবা ও দাদার ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য কাচারি ঘরটি সংস্কার করে রাখছেন। ফলে পূর্ব পুরুষদের অসংখ্য স্মৃতি বিজড়িত কাচারি ঘর আজও প্রাচীনতার বার্তা বহন করে আসছে।
প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই মুলাদী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষকগণ এ ঘরে থেকে বাড়ির এবং এলাকার মানুষদের শিক্ষা দিতেন। এক সময় এসএসসি পরীক্ষার কেন্দ্র মুলাদী ও হিজলা উপজেলা মিলে মুলাদী মাহমুদজান মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হতো। তখন হিজলাসহ বিভিন্ন স্কুলের ছাত্ররা এ ঘরে বিনা খরচে থাকতেন। কাচারি ঘরে থাকা অতিথিরা যেন বাথরুম, অজু ও গোসল করতে পারে সেজন্য ঘরের সামনে পাকা লেট্রিন, পুকুরে সানবাঁধানো ঘাট ও হাটাচলার জন্য একটি মাঠ রয়েছে।
ঘরটি চারচালা টিনের আর কাঠের হওয়ায় আস্তে আস্তে পুরানো হতে থাকে। বাড়ির পুরনো ঐতিহ্য হিসেবে ও পূর্ব পুরুষের নানা স্মৃতি বিজড়িত থাকায় বর্তমানে চারিদিকে পাকা দেয়াল করে উপরে চারচালা লাল রংয়ের টিন দিয়ে দেয়ালকে টাইলস দ্বারা ঘিরে কাচারিঘরটির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা হচ্ছে। খান বাড়ির এই কাচারি ঘরকে ঘিরে গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তিদের কাছে রয়েছে অসংখ্য স্মৃতি। বাড়ির অধিকাংশ পরিবার বরিশাল শহর, ঢাকাসহ দেশ-বিদেশে বসবাস করছেন। ফলে বাড়ির অন্যান্য ঘরের পাশাপাশি স্মৃতি বিজরীত কাচারি ঘরটি আধুনিকতায় তৈরী করেছে ভিতরে বিভিন্ন রং-বেরং এর নানা বাতি দিয়ে।
বিভিন্ন অঞ্চলের হুজুরগণ এখানে থেকে মসজিদে ইমামতি ও আরবি শিক্ষা দিতেন। এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিগণ বসে সমাজের উন্নয়নমূলক কাজে সহযোগিতা করতেন। এ বাড়ির সন্তান আবদুল জলিল খান এক সময় চেয়ারম্যান ও পরবর্তীতে মুলাদী, হিজলা ও মেহেন্দিঞ্জ আসনের এমপি হয়ে ওখানে বসে এলাকার মানুষের সুখ দুঃখের কথা শুনতেন এবং সেবামুলক কাজ করতেন। বর্তমানে ঐ বাড়ির নাতি ও পুতিগণ এখানে বসে বিভিন্ন ধরনের সেবামূলক কাজ করে যাচ্ছেন।