মঙ্গলবার, ২১ মে ২০২৪, ৭ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১
গণমাধ্যম ডেস্ক।।
‘হয়তো টিকাই একমাত্র সমাধান। কিন্তু করোনার ভ্যাকসিন তৈরির ইঁদুরদৌড়ে নেমে আমরা যেন থ্যালিডোমাইডের কথা ভুলে না-যাই!’ দিন কুড়ি আগে এই ‘পাঠকের চিঠি’ ছাপা হয়েছিল এক বৃটিশ সংবাদপত্রে। ছ’দশক আগেকার সেই ভয়ঙ্কর থ্যালিডোমাইড-অধ্যায় এখন বিস্মৃতপ্রায়। গতকাল চলে গেলেন এর বিরুদ্ধে এক সময়ে টানা ক্রুসেড-ক্যাম্পেন চালিয়ে যাওয়া বৃটিশ পত্রিকা ‘দ্য সানডে টাইমস’-এর প্রাক্তন সম্পাদক স্যর হ্যারল্ড ইভান্স।
সংবাদমাধ্যম ও প্রকাশনা জগতে সুদীর্ঘ ৭০ বছরের কেরিয়ার। বরাবরের ডাকাবুকো লেখক-সম্পাদক-প্রকাশক হিসেবে পরিচিত ইভান্স থামলেন বিরানব্বইয়ে। নিউ ইয়র্কে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ২০০৩-এ নাইট উপাধি পাওয়া ইভান্স।
নাইটপ্রাপ্তির আগের বছরেই ইভান্সকে ‘সর্বকালের সেরা সম্পাদক’ হিসেবে বেছে নেয় প্রেস গ্যাজেট এবং ব্রিটিশ জার্নালিজ়ম রিভিউ। কাগজের লে-আউট, ডিজ়াইন থেকে শুরু করে কোন খবর কোথায়-১৪ বছর কার্যত একার হাতে ‘দ্য সানডে টাইমস’ পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন ইভান্স। আর থেকে থেকেই সত্যের খোঁজে, মানুষকে সুবিচার পাইয়ে দিতে চালিয়ে যান ক্রুসেড-ক্যাম্পেন।
তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে বিবিসি-র প্রাক্তন সাংবাদিক রবার্ট হ্যারিস বললেন, ‘‘রেলকর্মীর ছেলে ইভান্স সানডে টাইমসে বহিরাগত হিসেবেই যোগ দিয়েছিলেন। তার পরে দেখলাম, প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতাকেই অভ্যাসে পরিণত করে ফেললেন। সেটা ছড়িয়ে দিলেন আমাদের মধ্যে।’’
তারপরে? কাগজের মালিক তার নিরপেক্ষ সাংবাদিকতায় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছেন দেখে ১৯৮১-তে সানডে টাইমস ছেড়ে বেরিয়ে যান ইভান্স। পরেও এন্তার লিখেছেন, আর বই ছেপেছেন। ‘সত্যি কথা স্পষ্ট করে কী ভাবে লিখবেন’- শিখিয়েছেনও। ‘ডু আই মেক মাইসেল্ফ ক্লিয়ার’ বইয়ে যেন অনুজ সাংবাদিকদেরই বুঝিয়েছেন-কেন শুধু ‘ভালো লেখাটাই’ জরুরি।
সানডে টাইমস ছাড়ার বছর তিনেক পরে দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী টিনা ব্রাউনকে নিয়ে ১৯৮৪-তে আমেরিকায় চলে যান ইভান্স। মার্কিন নাগরিকত্বও নেন। ২০০০-এ তিনি রোজকার সাংবাদিকতা থেকে সরে এসে বই লেখায় মন দেন। পাশাপাশি অবশ্য দ্য উইক, বিবিসি-রেডিও, দ্য গার্ডিয়ানে যাতায়াত করতে থাকে তার কলম ও স্বাধীন চিন্তাভাবনা।
তবে সানডে টাইমসে থাকাকালীন তার থ্যালিডোমাইডের বিরুদ্ধে লড়াইটাই বেশি স্মরণে রাখতে চাইছেন অনেকে। থ্যালিডোমাইড মানে সেই জার্মান ‘ওয়ান্ডার ড্রাগ’-সন্তানসম্ভবাদের ‘মর্নিং সিকনেস’ কাটাতে ‘সামান্য সিডেটিভ’! ১৯৫৬ থেকে ১৯৬১-র মধ্যে যা মুড়িমুড়কির মতো বিকিয়েছিল ৪৬টি দেশে। তার পরে? অবিশ্বাস্য ছোট-ছোট হাত, কারও পাকানো দড়ির মতো পা, অনেকেরই ছড়িয়ে থাকা হাতের পাঞ্জায় বুড়ো আঙুল নেই, কারও যৌনাঙ্গ উধাও, কেউ অন্ধ- ১০ হাজার বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম হলো। আর জন্মের আগেই মরল অন্তত এক লক্ষ!
সেটা কি শুধুই দুর্ঘটনা? অনেকেই বলেন, ওই ওষুধের ‘ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল’ হয়েছিল জার্মানির কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে। থ্যালিডোমাইড আবিষ্কার করেছিলেন সারিন নার্ভ গ্যাসের জনক ‘ডেভিল’স কেমিস্ট’-খ্যাত অটো অ্যামব্রস। পরে ওষুধের বিষক্রিয়া প্রমাণিত হয়। ১৯৬৮-র জানুয়ারিতে ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থা গ্রুয়েন্থালের ১৮ জন দোষী সাব্যস্তও হয়। কিন্তু ইতিমধ্যেই তার জেরে জন্মানো বাচ্চাগুলো আর তাদের পরিবারের কী হবে-এই ভাবনা থেকেই ১৯৭২-এ থ্যালিডোমাইডের বিরুদ্ধে প্রচার শুরু করেন ইভান্স। ওই জার্মান ওষুধ কোম্পানিকে নিশানা করার পাশাপাশি, ক্ষতিপূরণের অঙ্ক বাড়াতে চাপ দিতে থাকেন কাগজেরই বড় বিজ্ঞাপনদাতা বৃটেনে ওই ওষুধের ডিস্ট্রিবিউটরকে। নিজের ওই লড়াই প্রসঙ্গে সম্প্রতি ইভান্স বলেছিলেন, ‘‘আমি শুধু অন্ধকারে আলো ফেলেছিলাম। তাতে আগাছার দেখা মিললে, তা উপড়ে ফেলাই ভালো।’’
তড়িঘড়ি করোনা টিকা আনার দৌড়ে এখন তাই থ্যালিডোমাইডের সেই ভয়াবহ অধ্যায় আর ইভান্সের লড়াইটা ঝালিয়ে নেওয়ার কথা বলছেন অনেকেই।- সংবাদসংস্থা