সোমবার, ০৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ, ১৪৩১
শামীম তালুকদার।।
ইবানা রহমানকে এক পলক দেখার নিষ্পাপ চাহনি এক যুগ ধরে সময় অসময়ে আমার বক্ষ দেশে ছুরিকাগাত করে আসছে। অনেক সাধনার পর প্রেয়সীর চাঁদ মুখ দেখতে যাচ্ছি এই অনুভূতিতে ক্রাশ খেয়ে ফেলেছি। প্রেয়সীর অবয়ব দেখে মুগ্ধ হব। কান্তিময়ী হাঁসি জীবনে একটা পরিবর্তন নিয়ে আসবে। অপেক্ষার প্রহর মৃত পথের সমতুল্য যাত্রী। প্রেয়সী ওগো ভালবেসে খুলে দিও মনের দ্বার। নক্ষত্রের রাত, পূর্ণিমার চাঁদ। টেমস নদীর তীর। জীবন যুদ্ধে পালাবোনা কভু যদি হাতে রাখো ওই হাত। আমার অস্তিত্ব জুড়ে শুধু তুমি আর তুমি। রাজ মহলে বসে ঢালিতেছ স্বর্গসুধা আর আমি কল্পনার সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছি। তুমি জন্মেছ ইংরেজ দেশে। বড় হয়েছ অত্যাধুনিক পরিবেশে। মেধায় মননে প্রজ্ঞায় অনেক এগিয়ে তুমি। জানি গ্রামের ছেলেদের প্রতি তোমার অনিহা। দীর্ঘদিন তোমার সাথে কথা বলা হয়না। তুমি বড্ড বেশি অভিমানি। এত অভিমান তোমাকে মানায়না। তোমার এই অভিমান অদ্ভুদ ভাবে অসম্ভব ভাংচুর করছে আমার ভিতরে।
তিলোত্তমা লন্ডন শহরের বুকে প্রথম রাত্রি নিদ্রাহীন কেটে ভোর হল। আবু সালেহিন ঘুম থেকে উঠে তার কর্মস্থলে চলে গেলেন। তার তিন মেয়ে। ছোট মামণিদের সঙ্গে নিয়ে সকালের নাস্তা করলাম। তার পর হাঁটতে হাঁটতে লন্ডন টাওয়ার ব্রিজে চলে গেলাম। আমি যে ঘরে উঠেছি এখান থেকে লন্ডন টাওয়ার ব্রিজ পায়ে হেটে প্রায় পাঁচ মিনিটের দুরত্ব। ভবনের পাঁচ তলা উপর থেকে স্পষ্ট লন্ডন টাওয়ার ব্রিজ দেখা যায়। লন্ডল একটি চমৎকার শহর। টেমস নদীর তীরে অবস্থিত দ্ইু হাজার বছর পুরাতন একটি শহর। ভ্রমন পিপাসু মানুষের ভ্রমনের তালিকায় অবশ্যই থাকবে লন্ডন শহর। টেমস নদীর উত্তর তীরে প্রায় হাজার বছরের পুরোনো টাওয়ার অফ লন্ডন, বাকিংহাম প্যালেস লন্ডনের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের বাড়ী, মাদাম তুসো মিউজিয়াম, ওয়েস্ট মিনিস্টার এবে, বিগ বেন আরও অনেক কিছু। লন্ডন শহরের একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্ডারগ্রাউন্ড ষ্টেশন অলগেট। এখানে বাস ষ্টপও আছে। এই অলগেইট ষ্টেশনের হাঁটা দূরত্বে অলগেইট ইষ্ট ষ্টেশন। সেখান থেকে বেরোলেই মিলে বাঙ্গালিদের আনাগোনা। এখানেই বিখ্যাত ব্রিকলেইন এবং আলতাব আলী পার্ক। এর পাশেই ইষ্ট লন্ডন মসজিদ। আন্ডারগ্রাউন্ড ষ্টেশন অলগেইট ইষ্টের পরই হোয়াইট চ্যাপেল ষ্টেশন। ভ্রমণে লন্ডন এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। এখানে আছে আভিজাত্য, আছে জ্ঞান, দর্শন, বিজ্ঞান। লন্ডনের সংস্কৃতি, এখানকার মানুষের আচার ব্যবহার-শিষ্ঠতাও মুগ্ধ করে। পরিকল্পিত শহর লন্ডনের জীবনযাত্রাও এক উপভোগ্য ভ্রমণ উপাদান। টাওয়ার ব্রিজ ঘুরে দেখে বাসায় ফিরলাম। বিকেলে ইস্ট লন্ডন মসজিদের পাশে আবু সালেহিনের কর্মস্থল দেখতে গেলাম। ঘর থেকে পায়ে হেঁটে প্রায় দশ মিনিটের রাস্তা। সেখানে অনেক সময় গল্প ও চা চক্রের মধ্যে কাটিয়ে একসাথে ঘরে ফিরলাম।
পরদিন ইবানাদের ঘরে দুপুরের খাবার খাওয়ার আমন্ত্রন। আবু সালেহিন নিজে গাড়ী ড্রাইব করে ইবানা রহমানের ঘরের সামনে নামিয়ে দিলেন। কলিং বেলে চাপ দিলাম। ইবানার বাবা দরজা খুলে দিলেন। ভিতরে প্রবেশ করে গেষ্ট রুমে বসলাম। তার পর ইবানার মা আসলেন। পিছনে মৃদু পায়ে হেঁটে আসছে স্বপ্নের রাজকুমারী ইবানা রহমান। আমি ইবানার দিকে চেয়ে আছি অপলক। তার মায়াবী চেহারায় যে নুরের জলক দেখেছিলাম এখন আর তা দেখতে পাইনি। ইবানা নতজানু হয়ে মাটির দিকে চেয়ে হাঁটছে। এক পলকের জন্য ইবানা আমার দিকে চোখ তুলে থাকায়নি। লক্ষ করি ইবানার পিছু পিছু হেঁটে আসছেন একজন ভদ্রলোক। দুজনেই এক সাথে গেষ্ট রুমে প্রবেশ করে সোফায় বসলেন। ইবানার মা (আন্টি) আমাকে ওই ভদ্র লোকের সাথে পরিচয় করে দেন। এই হলেন ইবানার স্বামী।
আমি কাঁঁদিতে চেয়েও কাঁদিতে পারনি। চোখের সমুদ্রে জল শুকয়ে গেছে। বক্ষদেশ এক মুরভূমিতে পরিনত হয়েছে। কিছু পেয়ে কিছু হারালাম নাকি কিছু হারিয়ে কিছু পেলাম। আবার কলিং বেল বেজে উঠলো। এসেছে আরমান রশীদ। আরমান অনেক আগেই ভিজিট ভিসায় লন্ডনে এসেছে। বৈধভাবে বসবাসের অনুমতি পায়নি। সে বয়সে ইবানার ছোট। আরমান গেস্ট রুমে প্রবেশ করে কুশল বিনমিয় শেষে সোফায় বসেছে। আরমানকে উদ্দেশ্য করে ইবানা ছেছিয়ে বলে, এই তোমরা লন্ডন কেন এসেছ ? তোমাদের লন্ডন আসার কি প্রয়োজন ছিল ? যেভাবেই হোক একবার এসেছ আরেকবার কি করে আস দেখা যাবে ? ইবানার অমার্জিত এসব কথা শুনে তার স্বামী আপত্তি প্রদান করেন। ভদ্রলোক ইবানাকে বলেন তুমি এসব কি বলছ। এভাবে কথা বলা ঠিক হয়নি। ইবানা চুপ হলেও আমার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে অবিরাম। তুমুল ঝড়ে বক্ষ সমুদ্র উত্তাল হয়ে উঠেছে। একটি মুদ্রার এক পিঠে ভালবাসা আরেক পিঠে লেখা ঘৃণা। যাদের প্রেম যতো গভীর তাদের মুদ্রার ঘূর্ণন ততো বেশি। আমি অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছি। আমি হাঁটতে হাঁটতে এত দুর চলে এসেছি যে সামনে আর কোন পথই নেই। পথ আছে হয়ত আমি দেখছিনা।
গেস্ট রুমে আসেন ইবানার বাবা। ইবানা ও তার স্বামী দুজনেই চলে গেলেন ভিতরের রুমে। কিন্ত আমি আর আমার মাঝে নেই। আমি অস্তিত্বহীন এক জীবন্ত লাশ। ইবানার বাবাও আমার দিকে বাক্যের বিষাক্ত তীর নিক্ষেপ করতে শুরু করলেন। প্রতিটি শ্বাস প্রশ^াসে ভাবছিলাম এইটা আমার শেষ নিঃশ্বাস। অনুভব করছি চোখের আকাশে মেঘ জমেছে। চোখ দুটি দিয়ে অঝর ধারায় জল পড়ছে। জামা কাপড় ভিজে গেছে। দেহটা কাপছে থর থর করে। আমি স্বজ্ঞানহীন হয়ে পড়ি। জ্ঞান ফিরে পেয়ে দেখি ্ইবানার মা টেবিলে খাবার পরিবেশন করছেন। ইবানার বাবা আমার হাত ধরে তুলে নিয়ে খাবার টেবিলে বসালেন। জীবনে এই প্রথম জেনে শুনে বিষ পান করেছি। এত বিষাক্ত খাবার খাওয়ার পর মানুষ বেঁচে থাকার কথা নয়। শুধু তোমার জন্য আমি বেঁচে আছি। তোমাকে ভালবাসি বলে। খারাপ সময়টা হয়তো একদিন কেটে যায়। কিন্ত এ হৃদয় থেকে কেটে যায়নি বিরহের সন্ধ্যা। প্রেয়সী তোমার চোখে থাকিয়ে কাটিয়েছি যুগ। তুমিই দিয়েছে ফের শতাব্দির নি:সঙ্গতা। তোমার প্রতি অন্তহীন ভালবাসা ও শ্রদ্ধা। ইবানা রহমান ভালবাসি তোমাকে।
লেখক: সাংবাদিক।