শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ, ১৪৩১
গোলাম কিবরিয়া, বরগুনা।।
বরগুনার বহুল আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডের দুইটি বছর পূর্ণ হলো শনিবার (২৬ জুন)। ২০১৯ সালের ২৬ জুন বরগুনা সরকারি কলেজ গেটে প্রকাশ্যে শাহ্ নেওয়াজ রিফাত শরীফকে কুপিয়ে গুরুতর জখম করে সন্ত্রাসী নয়ন বন্ড বাহিনী। পরে ওই দিনই বিকেলে বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান রিফাত শরীফ।
রিফাতকে কোপানোর আগে মেসেঞ্জার গ্রুপ ০০৭ এ হত্যার পরিকল্পনা করে নয়ন বন্ড বাহিনী। ঘটনার পর দুই বছর অতিবাহিত হলেও এখনও রিফাতের স্মৃতি আঁকড়ে ধরে অঝোরে কাঁদেন তার মা-বাবা ও একমাত্র বোন। সকাল বিকাল ছেলের কবরের পাশে প্রার্থনায় মগ্ন হন তার মা ডেইজি আক্তার। নিহত রিফাতের স্বজনদের দাবি, আদালত খোলার সঙ্গে সঙ্গে যেন এ মামলার বিচার কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করা হয়।
স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নির সামনেই রিফাত শরীফকে প্রকাশ্যে কোপানোর একটি রোমহর্ষক ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়লে দেশজুড়ে শুরু হয় আলোচনা।
পুলিশি তদন্তে মিন্নিকে বানোনো নয় স্বামী রিফাত হত্যার মাস্টার মাইন্ড। ৭৬ জনের সাক্ষ্য গ্রহণশেষে মিন্নিকে মাস্টার মাইন্ড হিসেবে উল্লেখ করে স্ত্রী মিন্নিসহ প্রাপ্তবয়স্ক ৬ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেয় আদালত। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অন্য ৫ জন আসামি হলেন- রিফাত ফরাজী, রাব্বি আকন, সিফাত, টিকটক হৃদয় ও মোহাম্মদ হাসান।
নিহত রিফাতের বাবা আব্দুল হালিম দুলাল শরিফ বলেন, রিফাত আমার একমাত্র ছেলে ছিল। এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে আমার সুখের সংসার ছিল। মিন্নির কারণে আমার সেই সুখের সংসার ভেঙে তছনছ হয়ে গেছে।
তিনি কান্নায় ভেঙে পরে আরও বলেন, রিফাতের শূন্যতা কিছুতে পূরণ হবেনা। রিফাতের শোকে আমার স্ত্রী মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে গেছে। নানান রোগে আক্রান্ত হয়ে এখন শয্যাশায়ী। আমাদের ছেলে হত্যার বিচার কার্যকর হলে হয়তো কিছুটা আমরা সান্তনা পাবো।
প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালের ২৬ জুন রিফাতকে কুপিয়ে হত্যার করে। এ ঘটনার পরের দিন বরগুনা সদর থানায় ১২জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও ১০-১২ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন নিহত রিফাত শরীফের বাবা আব্দুল হালিম দুলাল শরীফ।
নিশংস এ হত্যাকাণ্ডের ৬ দিন পর এ মামলার প্রধান আসামি বন্ড বাহিনী প্রধান সাব্বির আহমেদ নয়ন ওরফে নয়ন বন্ড পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। এছাড়াও এ হত্যাকাণ্ডের ২০ দিন পর এ মামলার প্রধান সাক্ষী ও নিহত রিফাতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিকে ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। রিফাত হত্যাকান্ডের পরবর্তী সময়ে নানা নাটকীয়তার কারণে এই ঘটনার সংবাদ স্থান পায় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও।
পরে দীর্ঘ তদন্ত শেষে ওই বছরের ১ অক্টোবর বিকেলে প্রাপ্তবয়স্ক ও অপ্রাপ্তবয়স্ক এই দুই ক্যাটাগরিতে ২৪ জনকে অভিযুক্ত করে বরগুনার সিনিয়ার জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে পুলিশ। এতে ১০ জন প্রাপ্তবয়স্ক এবং ১৪ জন অপ্রাপ্তবয়স্ককে আসামি করা হয়।
এরপর আদালত অভিযোগপত্র গ্রহণ করে প্রাপ্তবয়স্ক আসামিদের বিচার কাজ শুরুর জন্য জেলা ও দায়রা জজ আদালত এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক আসামিদের বিচার শুরুর জন্য শিশু আদালতে মামলাটি প্রেরণ করেন। পরে ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি বরগুনা জেলা ও দায়রা জজ আদালত প্রাপ্তবয়স্ক ১০ আসামির বিচার কাজ শুরু করেন। আর একই বছরের আট জানুয়ারি বরগুনার শিশু আদালত অপ্রাপ্তবয়স্ক ১৪ আসামির বিচার কাজ শুরু করেন। পরে দেশে করোনা পরিস্থিতির অবনতির কারণে আদালত বন্ধ হয়ে যাওয়ার ওই বছরের আট মার্চ থেকে ছয় মাসের জন্য এ মামলার বিচার কার্যক্রম বন্ধ থাকে।
পরে করোনা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার পর ওই বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর প্রাপ্তবয়স্ক ১০ আসামির রায় ঘোষণা করেন আদালত। এ রায়ে নিহত রিফাতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিকে হত্যাকাণ্ডের প্রধান পরিকল্পনাকারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়। রায়ে মিন্নিসহ ৬ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। আর বাকি চার আসামিকে খালাস প্রদান করেন আদালত।
অন্যদিকে বিচার কাজ শেষ একই বছরের ২৭ অক্টোবর অপ্রাপ্তবয়স্ক ১৪ আসামির রায় ঘোষণা করেন বরগুনার শিশু আদালত। এতে হত্যাকাণ্ডের সরাসরি অংশ নেওয়ায় অপ্রাপ্তবয়স্ক ৬ আসামিকে ১০ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করে আদালত। এছাড়াও চার জনকে পাঁচ বছর এবং এক আসামিকে তিনি বছরের কারাদণ্ড দিয়ে তিনজনকে খালাস প্রদান করা হয়। পরে নিম্ন আদালতের এ রায়ের পর উচ্চ আদালতে আপিল করেন দণ্ডিত সকল আসামি।