বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ, ১৪৩১
অনলাইন ডেস্ক।।
দুই বছর না পেরোতেই সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত চিকিৎসক শাম্মির শাকিরের বিএমডিসি নিবন্ধন নম্বর আরেকজনের হয়ে গিয়েছিল। ওই নম্বর ব্যবহার করে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মাওনায় জাঁকিয়ে নিজেকে চিকিৎসক পরিচয় দিয়ে রোগী দেখছিলেন এক ব্যক্তি। তাঁর নাম নিরব নাহিয়ান। তিনি আসলে অস্ত্রোপচারকক্ষের (ওটি) বয়।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কলেজ কাউন্সিলের (বিএমডিসি) নিবন্ধন নম্বর ছাড়া কেউ ডাক্তারি করতে পারেন না। এই নম্বরের বিপরীতে চিকিৎসকের নাম, ছবি, ঠিকানা, যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পাস করেছেন সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম, ডিগ্রিসহ প্রয়োজনীয় সব তথ্য বিএমডিসির ওয়েবসাইটে সংরক্ষিত থাকে।
চিকিৎসকদের ফেসবুকভিত্তিক একটি সংগঠন প্রথমে এ ঘটনা জানতে পারে। এ নিয়ে লেখালেখির পর নিরব নাহিয়ান নামের কথিত চিকিৎসক গা ঢাকা দিয়েছেন। সংগঠনটির উদ্যোক্তা চিকিৎসক মো. আশরাফুল হক প্রথম আলোকে বলেন, মেহেদী হাসান নামের এক চিকিৎসক প্রথমে বিষয়টি জানতে পারেন। তিনি তা সবাইকে জানালে আরেক চিকিৎসক গাজীপুরের মাওনায় লাইফ কেয়ার হাসপাতালে নিরব নাহিয়ানের খোঁজ নেন। চিকিৎসকেরা খুঁজছে জানতে পেরে নিরব নাহিয়ান গা ঢাকা দেন। তাঁর এলাকায় গিয়ে চিকিৎসকেরা জানতে পারেন, তিনি কোনো একজন শল্যচিকিৎসকের দলে ওটি বয় ছিলেন।
ক্ষুব্ধ চিকিৎসকেরা এ ঘটনার জন্য বিএমডিসিকে দায়ী করেছেন। বিএমডিসির ওয়েবসাইটে শাম্মির শাকিরের নিবন্ধন নম্বরের বিপরীতেই নিরব নাহিয়ানকে পাওয়া যায়। এ নিয়ে চিকিৎসকদের পেজে আলোচনা শুরু হলে গত মঙ্গলবার দুপুরের দিকে বিএমডিসির ওয়েবসাইট থেকে নিরব নাহিয়ানের তথ্যগুলো উধাও হয়ে যায়। এখন আবার ওই নম্বরে শাম্মির শাকিরের তথ্য দেখা যাচ্ছে।
২০১৮ সালের জুলাইয়ে গাজীপুরে বিআরটিসি বাসের ধাক্কায় চিকিৎসক শাম্মির শাকির নিহত হন। তিনি তায়রুননেছা মেমোরিয়াল মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে মেডিকেল অফিসার হিসেবে কাজ করছিলেন। পাশাপাশি তিনি উচ্চতর ডিগ্রির জন্য লেখাপড়াও করছিলেন। দুর্ঘটনার বিচার চেয়ে শাম্মির শাকিরের মৃত্যুর পর টানা বেশ কয়েক দিন মেডিকেল শিক্ষার্থী ও চিকিৎসকেরা রাস্তায় নেমেছিলেন।
শাম্মির শাকিরের বিএমডিসি নিবন্ধন নম্বর ৭০১৩৯। অথচ ওই নিবন্ধন নম্বরের বিপরীতে বিএমডিসির ওয়েবসাইটে নিরব নাহিয়ানের ছবি ছিল। সেখানে বাবার নাম আরফানুর রহমান, স্থায়ী ঠিকানা কুমিল্লা লেখা ছিল।
চিকিৎসকেরা জানান, গাজীপুরের মাওনা চৌরাস্তায় লাইফ কেয়ার হাসপাতালে নিয়মিত রোগী দেখেন কথিত চিকিৎসক নিরব নাহিয়ান। চিকিৎসার ব্যবস্থাপত্র যে ফাইলে দেওয়া হয়, সেখানে তিনি নিজেকে মেডিসিন, বাতব্যথা ও জেনারেল সার্জারি বিষয়ের চিকিৎসক বলে পরিচয় দেন। তাঁর ডিগ্রির ঘরে লেখা আছে এমবিবিএস, সিএমইউ, পিজিটি, ডিএমইউ, এমএস (কানাডা)। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে উল্লেখ করেছেন নদার্ন অন্টারিও স্কুল অব মেডিসিন। রোগী দেখার সময় লেখা আছে শনি থেকে বুধবার বিকেল ৪টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। সিরিয়ালের জন্য একটি নম্বরও দেওয়া আছে।
ওই নম্বরে ফোন করলে প্রথমে হাসপাতালের অভ্যর্থনাকারী আবদুস সামাদ ও শাহীনা সারোয়ার এবং পরে লাইফ কেয়ার হাসপাতালের ব্যবস্থাপক মো. আবুল হাসান হোসেন কথা বলেন। তাঁদের তিনজনই নিজেদের নতুন কর্মী বলে পরিচয় দেন। তাঁরা নিরব নাহিয়ানকে ‘সেভাবে’ চেনেন না বলে দাবি করেন। তবে মাঝে মাঝে নিরব তৈরি পোশাক কারখানার অসুস্থ শ্রমিকদের লাইফ কেয়ার হাসপাতালে পাঠাতেন বলে জানিয়েছেন।
লাইফ কেয়ার হাসপাতাল নিরব নাহিয়ানের সঙ্গে যোগাযোগের কোনো নম্বর তাদের কাছে নেই বলে জানিয়েছে।
এদিকে বিএমডিসি নিশ্চিত করেছে সিএমইউ বা ডিএমইউ নামে কোনো ডিগ্রি নেই। এমবিবিএস পাস করার পর প্রশিক্ষণ কোর্সের নাম পিজিটি। এটিও কোনো ডিগ্রি নয়।
চিকিৎসক হিসেবে কাজ শুরুর আগে এমবিবিএস পাস করা শিক্ষার্থীদের বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) থেকে নিবন্ধন নিতে হয়। এ জন্য তাদের এমবিবিএস পাস করার প্রকৃত সনদ ও ফটোকপি, প্রশংসাপত্রের মূল কপি ও ফটোকপি, ইন্টার্নশিপ প্রশিক্ষণ সনদ, বিএমডিসিতে ব্যাংক ড্রাফট/পে অর্ডার/ক্যাশ পরিশোধের প্রমাণপত্র, যে মেডিকেল কলেজ থেকে একজন পাস করেছেন, সেই কলেজের অধ্যক্ষ দ্বারা সত্যায়িত করা তিনটি পাসপোর্ট আকৃতির ছবি, বিশ্ববিদ্যালয় নিবন্ধন কার্ডের আসল ও ফটোকপি, টিআইএন সার্টিফিকেট, জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি জমা দিতে হয়। এরপর বিএমডিসি থেকে আবেদনকারীকে সাময়িক একটি নম্বর দেওয়া হয়, যা ব্যবহার করে তিনি কাজ করতে পারবেন। এরপর এই নম্বর বিএমডিসিতে ফেরত দিয়ে সেখান থেকে স্থায়ী নিবন্ধন নম্বর নিতে হয়।
এত নিয়মকানুনের মধ্যে কীভাবে নিরব নাহিয়ান সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত চিকিৎসকের নিবন্ধন নম্বর বাগালেন, তা জানতে চাওয়া হয় লিয়াকত হোসেনের কাছে। তিনি বর্তমানে বিএমডিসির নিবন্ধকের দায়িত্ব পালন করছেন।
লিয়াকত হোসেন বলেন, ঘটনাটি জানতে পেরে তাঁরা নিরব নাহিয়ানের পরিচয়সংবলিত পেজটি বন্ধ করে দেন। কিন্তু তিনি বিএমডিসি পর্যন্ত পৌঁছালেন কী করে? এমন প্রশ্নে লিয়াকত হোসেন বলেন, তাঁরা এ বিষয়ে তথ্যপ্রযুক্তি শাখাকে তথ্য দিতে বলেছেন। এখনো জানেন না কী করে কী হয়েছে। সূত্র-প্রথম আলো