রূপালী ডেস্ক।।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সুশোভিত একটি জনপদের নাম লালমোহন। এখানে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন মনোরম অনেক দৃশ্য। প্রকৃতির অপূর্ব শোভায় শোভিত বাংলাদেশের বৃহত্তম প্রাচীন গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ ভোলার মধ্যস্থান লালমোহন। ভোলা জেলার অন্যান্য উপজেলার মতই লালমোহন উপজেলার প্রকৃতি এবং ইতিহাস ঐতিহ্য। এখানকার মানুষ আদি থেকেই মাটি ও নদীর সাথে প্রাণের গহীন মমতায় মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। এখানে পলিমাটি ও দোআঁশমাটির ভূমি। যার কারণে ভূমি খুব উর্বর। ফলন ভাল হয়। এখানকার অধিকাংশ লোক কৃষিজীবি। নদীর তীরবর্তী লোকজন বেশির ভাগ মাছ ধরার কাজে জড়িত। তাছাড়া ব্যবসায়ী, শ্রমিক, চাকরিজীবী ও দিনমজুরসহ নানান শ্রেণী পেশার মানুষ বসবাস করে।
প্রাচীনকালে মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদী বিধৌত অঞ্চলে বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষে পলি জমে জমে গাঙ্গের বুকে নতুন আশার আলো ছড়িয়ে জেগে উঠে একটি নতুন চর। একটি দ্বীপ। মানুষের হৃদয়ে জাগে নতুন স্বপ্ন। উত্তর দিক অর্থাৎ বর্তমানের ভোলার দিক থেকে চর পড়া শুরু হয়ে দক্ষিণ দিকে আসে বলে ধারণা করা হয়। কেননা ভোলা জেলার দক্ষিণে এখনো চর পড়ে। হিমালয় থেকে বয়ে আসা মেঘনা ও তেঁতুলিয়ার সাথে অনেকে ব্রহ্মপুত্র নদীর বিধৌত পলিমাটির কথাও বলেছেন সুরম্য এ ব-দ্বীপ গড়ে উঠার বিষয়ে। আবার কেউ কেউ যমুনা নদীর কথা বলেছেন। কৃষি আর মাছ শিকার করতে আসা লোকজন চরের বুকে বসবাস করতে শুরু করে। তবে সেই প্রাচীনকালের কোন একসময় চরের বেশিরভাগ এলাকাজুড়ে বিশেষ করে লালমোহনের বেশ কিছু এলাকা জুড়ে ঝোপঝাড় ও বনজঙ্গল ছিল বলে অনুমান করা হয়। এ দ্বীপের একটি অংশের নাম লালমোহন।
আজকে যে ভূখন্ডকে লালমোহন বলে জানি, মূলত পূর্বে এ নামটি ছিলনা। ভোলা জেলা এবং এর অন্তর্গত অন্যান্য উপজেলা ও বিভিন্ন এলাকার নাম কালক্রমে বদলে গেছে। নাম পরিবর্তনের কারণ জানতেও মানুষ ইতিহাস তথা বইয়ের পাতায় চোখ রাখে। এটা একদিকে যেমন কৌতূহল অন্যদিকে আবার জ্ঞান আহরণ। লালমোহনের আধি নাম ছিল মেহেরগঞ্জ। লালমোহন নামকরণের ইতিহাস একটি ব্যতিক্রম ঘটনা। আনুমানিক ১৯০৪ সালের দিকে বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক অবস্থান ও সুযোগ সুবিদা বিবেচিত করে স্থানীয় মরহুম মেহের আলী পাটোয়ারী তার নিজস্ব ভূমির উপর একটি সাধারণ হাট বা বাজার প্রতিষ্ঠা করেন। নিজের নাম অনুসারে এর নাম রাখেন ‘মেহেরগঞ্জ’। কিন্তু পরবর্তীতে লালমোহন ভূমি অফিসে একজন তহসিলদার আসেন যার নাম লালমোহন। তিনি সুকৌশলে একটি মৌজার নাম নিজের নামে ‘লালমোহন’ করে যান। যার কারণে লালমোহন হিসেবেই পরিচিতি পায় এ অঞ্চল। চাপা পড়ে যায় ঐতিহ্যবাহী মেহের আলী পাটোয়ারীর নামের ‘মেহেরগঞ্জ’। তবে মেহেরগঞ্জ নামে একটি মৌজা এখনো রয়েছে। ১৯১৯ সালের ৭ জানুযারি আনুষ্ঠানিকভাবে লালমোহন থানার কার্যক্রম শুরু হয়। থানাকে উপজেলায় রূপান্তর করা হয় ১৯৮৩ সালে।
একটি পৌরসভা ও ৯টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত লালমোহন উপজেলা। ধলীগৌরনগর ইউনিয়ন লালমোহন উপজেলার সবচেয়ে বড় ইউনিয়ন। লালমোহন থানার কিছু বিখ্যাত বাজার রয়েছে। মঙ্গলশিকদার বাজার, চতলা বাজার, গজারিয়া বাজার, ডাওরী বাজার, কর্তারহাট বাজার, লর্ডহার্ডিঞ্জ বাজার, রায়চাঁদ বাজার, হাজিরহাট বাজার, হরিগঞ্জ বাজার, দালাল বাজর, পাটোয়ারীর হাট বাজার। এই বাজারগুলো লালমোহন উপজেলার সবচেয়ে বিখ্যাত বাজার। অনেক পুরনো এবং আদি যুগ থেকে এ বাজজারগুলোর নামকরণ করা হয়েছে। লালমোহন উপজেলার আয়তন: ৩৯৬.২৪ বর্গ কিমি। উত্তরে বোরহানউদ্দিন এবং তজমুদ্দিন উপজেলা, দক্ষিণে চরফ্যাশন উপজেলা, পূর্বে মেঘনা নদী ও পশ্চিমে তেঁতুলিয়া নদী। ।
ইতিহাস ঐতিহ্যে লালমোহন অবিস্মরণীয়। সময়ের বিবর্তনে অনেক কিছু বদলে যাবে কিন্তু স্মৃতি কিংবা ইতিহাস থেকে একেবারে মুছে যাবেনা। লালমোহনের বাসিন্দারা প্রাচীনকাল তথা চর আমল থেকেই জলদস্যু, খড়া, বন্যা, জলোচ্ছ্বাসসহ নানান রকম প্রতিকুলতার সাথে প্রাণপণে যুদ্ধ করে এখানকার কাঁদাজলে মিশে আছে। একই অবস্থা সমগ্র ভোলাবাসির।
ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯১৯ সালে লালমোহন থানা গঠিত হয়। পরবর্তীতে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৮৩ সালে লালমোহন থানাকে উপজেলায় রূপান্তর করা হয়। ভোলা জেলার অন্তর্গত লালমোহন উপজেলায় ১টি পৌরসভা ও ৯টি ইউনিয়ন রয়েছে। এই উপজেলায় ৫৫টি মৌজা ও ৭৪টি গ্রাম রয়েছে। নদী মাতৃক অঞ্চল ভোলার লালমোহন স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ও বৈচিত্রের প্রদীপ জ্বেলে আমাদের হৃদয়ে মিশে আছে।
মোঃ জসিম জনি, সাধারণ সম্পাদক, লালমোহন প্রেসক্লাব।