বুধবার, ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ, ১৪৩১
ডাঃ মো: আলী হাসান।।
বিষয়টা অপ্রিয় সত্য হলেও এটাই বাস্তব যে স্বাস্থ্য ক্যাডারে যারা আছে তারা শুরু থেকেই একটা বঞ্চনার ভিতর দিয়েই চাকরি জীবন শুরু করে। এটা কমবেশি সবাই জানে, তবে সবচেয়ে বেশি কষ্টদায়ক ব্যাপার হলো এগুলো নিরসনের জন্য যাদের সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখার কথা সেই বিএমএ এখানে চরম ব্যর্থতার প্রমাণ দিয়েছে। তবে এগুলো বলে সাধারণ ডাক্তারদের আর কোন লাভ হবে না। আমাদের ভাগ্যের নির্মম পরিহাস এই ক্রিমগুলো এখন সমাজে কসাই হিসেবে পরিচিত। তার বড় প্রমাণ খুলনার একজন সিনিয়র ডাক্তারকে দিনে দুপুরে পিটিয়ে মারলো তাতে আমাদের সমাজে কোন হৈচৈ হলো না। স্বয়ং আমাদের মন্ত্রণালয়ের তেমন কারো কোন প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেল না যতদূর আমি জানি।
অথচ একজন ইউএন ও আহত হয়েছেন সেখানে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীতো গেছেনই, স্বাস্থ্য মন্ত্রীও তার চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছেন। এতে আমরাও খুশি যে একজন সরকারি কর্মকর্তার পাশে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সহানুভূতি জানানো হয়েছে। বিষয়টা যদি সবার বেলাতেই হতো তাহলে আমাদের কোন কষ্ট হতোনা। ডাক্তাররা সমাজে আজ এতই অবহেলিত অথবা মূল্যহীন যে ডাক্তারকে মেরে ফেললে পাবলিকও কিছু মনে করেনা, অথচ একজন ইউএনও আহত হয়েছেন তার জন্য বিভিন্ন উপজেলায় পর্যন্ত মানব বন্ধন হচ্ছে। এখান থেকে বের হয়ে আসতে চাইলে, নিজেদেক রক্ষা করতে হলে আর কারো মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে লাভ হবে না। কিছু সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা নিয়ে আমাদেক সরকারের নীতি নির্ধারকদের সাথে আলোচানা করতে হবে এবং চেষ্টা করতে হবে সেগুলো বাস্তবায়নের। আমরা চাকরি বিধি অনুযায়ী ন্যায্য অধিকার পাবো সেটা আর আশা করে লাভ নাই, আমরা যেন চাকরিস্হলে সামাজিকভাবে থাকতে পারি এটুকু হলেও অন্তত তৃপ্তি পাওয়া যাবে।
আমাদের সামাজিক অবমূল্যায়নের মূল জায়গা উপস্বাস্হ্য কেন্দ্র যদিও সেখানে কোন সেবা দিতে পারে না। এই উপস্বাস্হ্য কেন্দ্রের মেডিক্যাল অফিসারের পদটা বিলুপ্ত করতে হবে।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে হবে গ্রামীণ স্বাস্হ্য ব্যবস্হার মূল কেন্দ্র। এখন অবকাঠামোগতভাবে এ স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলো এ স্বাস্থ্যসেবা দিতে সক্ষম। দরকার যেটা সেটা হলো কিছু নির্দিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পদায়ন, সাথে তাদের কাজ করার সব সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করা। উপস্বাস্হ্য কেন্দ্রের পদগুলো বিলুপ্ত করে সেগুলোকে উপজেলাতে ন্যস্ত করা যাতে করে তারা বিশেষজ্ঞদের সহযোগী হিসেবে কাজ করতে পারে, আউটডোর, ইনডোর, জরুরি বিভাগ সামলাতে পারে।
উপজেলার অভ্যন্তরে যোগাযোগ ব্যবস্হার উন্নয়ন করা যাতে করে কোন জরুরি রোগী যেন খুব দ্রুত হাসপাতালে আসতে পারে। এক্ষেত্রে প্রয়াত রাস্ট্রপতি এরশাদ সাহেবের জিসিসিআর প্রকল্পের কথা স্মরন করা যেতে পারে, ওটা ছিল গ্রামীণ যোগাযোগ ব্যবস্হার একটা যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
যে প্রস্তাবগুলোর কথা বললাম তার অনেকগুলোই ইতিমধ্যে হয়েও গেছে যেমন অবকাঠামো, বিশেষজ্ঞ এবং সহযোগীদের পদ সৃষ্টি ইত্যাদি। এখন দরকার বাস্তবমুখী পরিকল্পনা এবং তার বাস্তবায়ন।
বর্তমানে প্রতিবছর বিভিন্ন বিষয়ে অনেক বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বের হচ্ছে, তাদেক উপযুক্ত পদমর্যাদা দিয়ে অতিসহজে এখানে কাজে লাগানো যায়। এখন এমনও দেখা যাচ্ছে চিকিৎসা বিদ্যায় কোন বিষয়ে উচ্চতম ডিগ্রী নিয়েও হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ফাটা মাথা সেলাই করছে, বা পোস্টমর্টেম সার্টিফিকেট দিচ্ছে অথবা বুকের ব্যথার রোগী নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে অথবা ইন্জুরি সার্টিফিকেট মনের মত না হবার জন্য গালাগালি খাচ্ছে অথচ সে হয়তো এফসিপিএস/এমডি (শিশু)।
উপজেলা হাসপাতালগুলোকে যদি আমরা কমন কিছু রোগীর চিকিৎসা নিশ্চিত করতে পারি তাহলে মানুষ আর জেলা হাসপাতাল বা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে অকারণে যাবেনা, অনেক দিক দিয়েই জনগণ উপকৃত হবে।
এখন প্রত্যেকটি উপজেলাই ছোটখাটো শহর, এখানে আধুনিক নাগরিক সুযোগ সুবিধার প্রায় সবগুলোই আছে, ভাল সরকারি বেসরকারি আবাসিক ব্যবস্হা, উন্নত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সামাজিক বিনোদনের প্রায় সব ব্যবস্হাইফ এখন এখানে বিদ্যমান। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার যারা আসবেন তারা যেমন তাদের সাপোর্টিং মেডিক্যাল অফিসার পাবেন, মেডিক্যাল অফিসারদেরকেও আর অন্ধকারে হাতরাতে হবেনা, এ রোগী নিয়ে কি করবে। এতে করে জুনিয়র ডাক্তারদের দক্ষতা বাড়তেই থাকবে, বিশেষজ্ঞরাও নির্ভার থাকতে পারবে। দিনের পর দিন ভিটামিন আর আয়রণ লেখার চাইতে এটা কেমন হবে একজন মেডিক্যাল অফিসারের জন্য? সে এখন নিজেকে একজন ডাক্তার ভাবতে পারবে।
আর একটা বিরাট মানসিক শান্তির বিষয় হবে সেটা হলো বিরাট একটা সমমনা সমাজ, যে সমাজ তাকে অফিসার হিসেবে পরিচয় দিতে সাহায্য করবে। আর একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হবে সেটা হলো ডাক্তারদের সামাজিক নিরাপত্তা। আজকাল অহরহই ডাক্তাররা নাজেহাল হচ্ছে, এরকম অবস্হা হলে একজনের বিপদে আরো চারজন এগিয়ে আসবে।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মেধাবীদের সন্তান মেধাবী হয় কিন্তু তারজন্য দরকার উপযুক্ত সামাজিক অবস্হা। একটা শিশুর মেধা বিকাশে দরকার বয়ষভিত্তিক প্রয়োজনীয় তথ্য যা পায় তার পারিপার্শ্বিক পরিবেশ থেকে। এরকম একটা ডাক্তারসমাজ একজায়গায় থাকলে দেশ একটা মেধাবী জাতি পাবে।
বিশেষজ্ঞগণ যেন নিজেদেক বঞ্চিত মনে না করতে পারেন এ জন্য তাদেক নির্দিষ্ট সময় পরে জেলা হাসপাতাল বা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল বা কোন বিশেষায়িত হাসপাতালে পদায়ন করতে হবে। এতে তাদের কর্মস্পৃহা বাড়বে, পেশার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ সৃষ্টি হবে, হতাশা গ্রাস করতে পারবে না। এ কাজগুলো বাস্তবায়ন করা এখন তেমন কোন কঠিন বিষয় না, যেটা কঠিন বিষয় সেটা হলো সদিচ্ছা। আশাকরি সংশ্লিষ্ট সবাই এটা ভেবে দেখবেন।
লেখক: (শিশু বিভাগ) এর সাবেক সহকারী অধ্যাপক, শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বরিশাল।