শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ৩ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১
তাসফীর ইসলাম (ইমরান)।।
ঈদে বাসা ফাকা পেয়ে পাশের দুইটা বাসায় ডাকাতি হয়েছে। মূলত ভাড়াটিয়ারা কেউ না থাকায় ডাকাতরা বাড়িওয়ালাদের ভারি অস্ত্র দেখিয়ে লুটপাট চালায়। এ নিয়ে ছুটি শেষে ঢাকায় ফিরার পর এলাকা একটু থমথমে। রাস্তাঘাটে পুলিশের টহল থাকে তাই বেশী একটা বের হইনা। বাসায় বসে গান শুনছি এর মধ্যে ছোট ভাই এসে বললো ভাইয়া নিচে মনে হয় চোর আসছে। কেমন ধর ধর বলে চিল্লাচ্ছে। আমি চার তলা থেকে দৌড়ে নিচে নামলাম। বেশ কয়েকদিন আগে বাসা থেকে আমার ল্যাপটপ চুরি হয়েছিলো। সেই থেকে চুর পিটানোর জন্য হাত কেমন ইশফিশ করছে।
নিচে নামতেই মনটা ভেঙে গেলো। একটা পি-কাপ থেকে ধরাধরি করে জিনিসপত্র নামাচ্ছে। পাশের বাসায় নতুন ভাড়াটিয়া এসেছে। ভাবলাম এত কষ্ট করে নিচে নামলাম এক কাপ চা খেয়ে আসি। পাশ দিয়ে হেটে যেতেই আন্টির বয়সি এক মহিলা বললো বাবা এটা একটু ধরবা? চেনা নাই, জানা নাই, দেখেই বলে এটা একটু ধরবা এটা কেমন কথা!
দুইটা বালিশ ধরিয়ে বললো একটু তিন তলায় নিয়ে যেতে পারবা?
কি মুসিবত! বালিশ দুইটা ফেলে দিতে ইচ্ছে হলেও হাসিমুখে তিন তলায় নিয়ে গেলাম। একটা মেয়ে আমায় দেখেই দৌড়ে এসে বালিশগুলো নিয়ে বললো ধন্যবাদ ভাইয়া! তাকে দেখে আপু বলবো নাকি শুধু আপনি বলে এড়িয়ে যাবো বুঝে উঠতে পারছি না। তার বয়সটা চেহারার হাসিতে এসে কেমন আটকে যায়। হাসি দেখে মনে হলো সে আমার বয়সি আবার হাসি থামিয়ে দেওয়ায় মনে হলো আপু বলে ডাকি। সম্বোধনের এমন দু-টানায় বললাম একটু পানি দিবেন? এখনো তো কিছু গুছিয়ে উঠতে পারিনি, নিচ থেকে আনিয়ে দেই বলেই সে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো। আমি শুধু মাথা নাড়ালাম। যার অর্থ থাক লাগবে না। নেমে যাবো এমন সময় মেয়েটা বললো ভাইয়া একটু সাহায্য করবেন আমাদের? আম্মু আর আমি ছাড়া কেউ নাই, জিনিসপত্রগুলো উঠাতে সাহায্য করলে খুব উপকার হতো। কথাটা সে হাসি দিয়ে বললে আমি সাত পাচ চিন্তা না করেই রাজি হয়ে যেতাম। যেহেতু সে হাসি দেয়নি তাই আমি কিছুক্ষণ চিন্তা করে রাজি হলাম। কারন তার হাসিটা আমার ভালো লেগেছে। আমি সত্যিকারের শ্রমিক হলে কাজ শেষে পারিশ্রমিক হিসেবে তার হাসিটা চাইতাম! আমি মারাত্মক অলস। কাজে কর্মে আমার শরীর চলে না। তবুও মনে মনে রাজি হলেও চেহারায় একটা বিরক্তির ছাপ এনে জিজ্ঞাসা করলাম বাসা চেঞ্জ করার জন্য লোক রাখেন নি কেনো?
উত্তরের আগেই আমি নেমে গেলাম। মেয়েটা হয়তো ইনিয়ে বিনিয়ে কিছু একটা বলতো৷ ইনিয়ে বিনিয়ে কথা শুনতে ভালো লাগে না।
প্রায় ১ ঘন্টা ঘাম ঝরিয়ে সব জিনিসপত্র উপরে উঠিয়ে দিয়েছি। শরীর ব্যাথা লাগছে। যে ছোট ভাইটা বলেছে নিচে চোর ধরেছে তাকে দিয়ে আজ শরীর মেসেজ করাবো। বেটা মেসেজ করে দিতে না চাইলে থাপ্রাবো৷ আমার ঠিক যেখানে যেখানে ব্যাথা ওকেও ঠিক সেখানে মারবো। কাজ শেষ হওয়ার পর আন্টি হাসিমুখে বললো বাবা আজ যদি রাতে আমাদের সাথে চারটা ডাল ভাত খেতে তাহলে খুব খুশী হতাম। আমি “অবশ্যই খাবো আন্টি” বলে চলে আসলাম।
কাপড় ভিজিয়েছি অনেকগুলো। এখন আর কাপড় ধুইতে ইচ্ছে হচ্ছে না। এই শহরে ব্যাচেলরদের ইচ্ছে করে না রোগের মধ্যে সবচেয়ে বড় রোগ কাপড় ধুইতে ইচ্ছে না করা। এই রোগের মহামরি আকাড় আমার মধ্যে ধারন করেছে। স্টুডেন্ট পড়াতে যেতে হবে। একটা লুঙ্গী ছাড়া যা আছে সব ভিজিয়েছি। ছাত্রের মা ফোন দিয়ে বলেছে আজ যেন মিস না করি। তাই ভাবলাম আরামের কাছে শরমের কোন বেইল আছে? লুঙ্গী পড়ে আরাম করতে করতে পড়াতে চলে গেলাম।
কলিং বেল চাপতেই একটা পিচ্চি দরজা খুললো। বছরখানেক পড়াচ্ছি এর মধ্যে কখনো এই পিচ্চিকে দেখিনি। দরজা খুলতেই পিচ্চি বললো ময়লা নিতে এসেছেন? আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই “খালা আম্মু ময়লাওয়ালা এসেছে” বলে পিচ্চি ভিতরে চলে গেলো। স্টুডেন্টের মা ভিতর থেকে চিল্লাচ্ছে, “এখন কি ময়লা নেওয়ার সময়? সকালে ২ মিনিট দেরী হওয়ায় ময়লা না নিয়ে চলে গেছে৷ এখন সন্ধ্যায় আসছে ময়লা নিতে। ভাব বেড়ে গেছে এদের। টাকা কম দেই? থাপ্রানো উচিৎ!”
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আমার অবস্থা “না পারি কইতে, না পারি সইতে”। বেশ কয়েকবার গলা ঝারলাম যেন আমায় একটু শুনতে পারে অথচ কেউ আমায় বুঝে না। ভিতরে যে যাবো সেটাও পারছি না। ময়লাওয়ালার চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করতে করতে ছাত্রের মা দরজার সামনে এসে আমায় দেখে হা করে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে আমি সপ্তম আশ্চর্যের একটা! জিহ্বায় কামড় দিয়ে বললো স্যার আপনি? ময়লাওয়ালা কোথায়? বললাম জ্বী আমিই ময়লাওয়ালা। দেন ময়লা দেন নিয়ে যাই। অবশ্য এটা মনে মনে বলেছি! আর মুখে শুধু হাসি এনে রেখেছি৷ তরিগরি করে ছাত্রের মা বললো সরি স্যার, কিছু মনে নিয়েন না। আমিতো সত্যি সত্যিই ময়লাওয়ালা ভেবেছিলাম। ইট’স ওকে আপু, ব্যাপার না বলে ভিতরে ঢুকলাম।
“স্যার সত্যিই কিছু মনে করেননি তো”?
আমি বললাম না আপু কিছু মনে করিনি। ছাত্রের মা সকালের ঘটনা শুনালো। সে নাকি কাজ করছিলো। এর মধ্যে ময়লা নিতে এসেছে৷ তার নিচে যেতে দুই মিনিট দেরী হওয়ায় ময়লা না নিয়ে চলে গিয়েছে।
এটা আসলে মিথ্যা কথা। দুই মিনিটে ময়লাওয়ালা চলে যাওয়ার কথা না। আশেপাশের বাসা থেকে ময়লা নিতেও অন্তত ১০ মিনিট লাগার কথা। সে অবশ্যই ১০ মিনিটের বেশী দেরী করেছে৷ আমরা নিজেদের চেয়ে যাদের একটু নিচু মনে করি তাদের সমস্যার তিলকে তাল বানিয়ে তাদেরকে গালাগালি করতে পছন্দ করি। সেখান থেকে সুখ নেই৷ রুপ কথার গল্পের মতো হালকা মিথ্যা কথায় সাজানো গল্পও মনোযোগ দিয়ে শুনতে হয়৷ মনোযোগ দিয়ে ছাত্রের মায়ের ঘটনা শুনে জিজ্ঞাসা করলাম আপু তানজিল কোথায়? তানজিল আমার ছাত্র। আপু চেহারায় হঠাৎ মনে পড়লো একটা ভাব এনে বললো ” ও হ্যা স্যার আজতো তানজিলের জন্মদিন, এজন্যই আপনাকে বলেছিলাম যেন আজ মিস না করেন। ও ভিতরে কাজিনদের সাথে। আমি ডেকে দিচ্ছি”।
তানজিল আমায় দেখে বললো স্যার আপনি লুঙ্গী পড়ে আসবেন আমায় বলবেন না?
জিজ্ঞাসা করলাম বললে কি হতো? তানজিল এক্সাইটমেন্ট নিয়ে বললো আমিও পড়তাম তাহলে। যাও তাহলে এখনি পড়ে আসো।
খানিকবাদে রেগে পুড়ে যাচ্ছে এমন চেহারার একটা সুন্দরী মেয়ে এসে বললো, আপনি তানজিলকে লুঙ্গী পড়ার বুদ্ধি দিয়েছেন তাইনা?
” আমিতো দেইনি৷ ও নিজেই পড়তে চেয়েছে”৷
মেয়েটা আমায় শাসানোর মতো করে বললো, যেমন শিক্ষক তেমন ছাত্র। ও কি জীবনে লুঙ্গী পড়েছে? লুঙ্গী পড়ার জন্য কেমন তোলপাড় শুরু করে দিয়েছে। কেউ পড়াতে পারছে না লুঙ্গী। আর মামার যে লুঙ্গী এটাতো ও পড়তেই পারবে না৷ বরং ওর মতো তিনটাকে লুঙ্গির ভিতর ঢুকিয়ে বস্তা করে রাখা যাবে। আজকে ওর জন্মদিন, আমি ওর জন্য ড্রেস নিয়ে এসেছি৷ ওইগুলো পড়বে ও৷ আপনি এক্ষুণি ডেকে বলুন যেন লুঙ্গী না পড়ে।
আমি বললাম কেউ লুঙ্গী পড়িয়ে না দিতে পারলে আমার কাছে আসতে বলুন। আমি পড়িয়ে দিচ্ছি। মেয়েটা ভেংচি মেরে চলে গেলো! মনে মনে বললাম আমি কি মেয়েটাকে গালি দিয়েছি? তার বিরুদ্ধে কিছু বলেছি? তবুও সে ভিতরে গিয়ে এখন বলবে তানজিলের স্যার তো ভালো না। আমিতো ভালা না……… থাক বাকিটা আর না বলি!
তানজিলকে লুঙ্গী পড়িয়ে দিয়ে ছাদে গেলাম। জন্মদিনের জন্য এমন তাক লাগানো ডেকোরেশন কেউ করে আমার জানা ছিলো না। কেমন বিয়ে বিয়ে লাগছে। তানজিলকে বললাম আজ তোমার বিয়ে হলে ভালো হতো।
কেনো স্যার?
পরিবেশটা কেমন বিয়ে বিয়ে লাগছে।
আমার ছাত্র উত্তর দিলো আমার জন্মদিন এমনি হয়!
বেশ কয়েকটা ধাপে জন্মদিনের অনুষ্ঠান এগোতে লাগলো৷ তবে বেশির ভাগ মানুষ আমার দিকে কেমন আড় চোখে তাকাচ্ছে৷ ভাবটা এমন যে, এ ক্ষেত কোত্থেকে আসছে?
হঠাৎ তানজিল বললো স্যার আপনি না আমায় ফানি কবিতা শুনাবেন বলেছিলেন? এখন শুনাবেন৷
আমি বললাম বলেছিলাম নাকি?
অবশ্যই স্যার৷ এইতো কয়েকদিন আগে। দৌড়ে সামনে গিয়ে তানজিল এনাউন্স করে দিলো আমার স্যার এখন আপনাদের একটা ফানি কবিতা শুনাবে!
আমি ভেবে পাচ্ছি না কোন কবিতা বলবো এতগুলো মানুষের সামনে। ছোটবেলার “আম পাতা জোড়া জোড়া” কবিতা ছাড়া কোন কবিতাই আমার মনে নেই। তবে হুট করে নজরে পড়লো তানজিলের ওই কাজিনের দিকে৷ যার কিনা ড্রেস তানজিল না পড়ায় এখনো সে রেগে সাপের মতো মুচড়াচ্ছে।
আমি সামনে গিয়েই আমার কবি গুরু সুজন স্যারের শরাপন্ন হলাম। এই মুহূর্তে সুজন স্যারের কবিতা ছাড়া জমবে না। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলতে থাকলাম,
“ওই হ্যা, আমি তোমাকেই বলছি-
জীবন আমার রেলঘারি
পাইনা খুজে শশুরভারি”।
তানজিল কি বুঝলো জানি না তবে হাসতে হাসতে এর মধ্যে তার লুঙ্গী খুলে গিয়েছে। ক্লাস ফোরে পড়ায় লুঙ্গী খুলে যাওয়ায় তেমন একটা বিপত্ত্বি ঘটেনি। তবে উপস্থিত সবাই খুব হেসেছে। হাসেনি শুধু মেয়েটা!
মোটামুটি ভালো খাওয়া হয়েছে আজ। পেটে জায়গা একেবারেই নেই বলা চলে৷ ওইদিকে আন্টি বলেছিলো রাতে তাদের সাথে খেতে। খাওয়ার কোন ইচ্ছে নেই। তবে তাদের বাসায় যেতে ইচ্ছে হচ্ছে। বসে খাবোনা কিন্তু খাওয়ার অভিনয় করবো। প্লেট নিয়ে বসতেই ওই মেয়েটা খাবার বেড়ে দেওয়ার ছলে যদি একটু আমার দিকে তাকিয়ে হাসে তাহলে সেটাও বা কম কিসে?
কথা দিয়েছি বলে আমি তাদের বাসায় গেলাম। ১১ টা বেজে গেলেও তারা এখনো খায়নি। আমার জন্য অপেক্ষা করছিলো। নাম্বার নেই তাই ফোন দিতে পারছিলোনা। ব্যাপারটা দেখে কেমন অনুশোচনা হলো। ভরা পেটেও তাদের সাথে খেতে বসলাম। খাওয়ার ফাকে জিজ্ঞাসা করলাম আন্টি আঙ্কেলকে দেখছিনা যে? উনি হাসিমুখে উত্তর দিলো তোমার আঙ্কেল বেচে নেই বাবা। আমি অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। এই মুহূর্ত গুলোতে কি বলতে হয় আমি ঠিক জানিনা। তবুও বললাম আই এম সরি। আন্টি বললো সিনথি ওকে ভাত তুলে দে। জানলাম মেয়েটির নাম সিনথি । সিনথি আমাকে ভাত তুলে দিতে দিতে বললো, জানেন আব্বু কিভাবে মারা গিয়েছে? আন্টি সিনথিকে ধমক দিলো। ধমকের মধ্যে কেমন একটা রহস্য আবার বিষাদের ছোঁয়া আছে!
আমি তেমন কোন কথা না বাড়িয়ে খেয়ে উঠলাম। বিদায় নিয়ে বের হয়েছি ঠিক তখন সিনথি দৌড়ে দরজায় এসে আমায় একটা কাগজের টুকরা দিলো যেখানে একটা নাম্বার লিখা। বললো আপনাকে একটা গল্প বলবো, যদি পারেন ফোন দিয়েন। মোটামুটি একটা ঘোর নিয়ে বাসায় আসলাম।
পরপর দুইবার খেয়ে শরীরের বেসামাল অবস্থা। আবার এদিক দিয়ে শরীর ব্যাথা। ছোট ভাইটাকে ধরে এনে শরীর মেসেজ করাচ্ছি। ছেলেটা কাজের আছে। আমার ঘুম পেয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ মনে হলো সিনথিকে ফোন দেওয়া উচিৎ।
সিনথি ফোন ধরতেই বললাম আমি সাগর। একটু আগে আপনাদের বাসায় খেয়ে এসেছি। সিনথি বললো চিনেছি। জানেন আব্বু কিভাবে মারা গিয়েছে?
বললাম কিভাবে?
আমার ডিভোর্স হওয়ার এক সপ্তাহ পর আব্বু ব্রেইন স্টোক করে৷ দুইদিন হসপিটালে থাকার পর মারা যায়৷ আমি অবাক হয়ে বললাম আপনার ডিভোর্স মানে?
হ্যা ডিভোর্স। আব্বু একটা এনজিওতে জব করতেন এবং সে খুব ধার্মিক ছিলো। কলেজের সেকেন্ড ইয়ারে উঠার পর আব্বু আমাকে বিয়ে দিয়ে দেওয়ার জন্য কেমন অস্থির হয়ে উঠে। আব্বুর পরিচিত একজন ছেলে ছিলো৷ মেয়েদের বিয়ে আগে দেওয়াই নাকি উত্তম। একমাত্র সন্তান হওয়ায় আব্বু আমায় অসম্ভব ভালোবাসতো। আমি তার সব কথা শুনতাম। পরিচিত হুজুর টাইপ ব্যাবসায়ীক ছেলের সাথে ধুমধাম করে আমার বিয়ে হয়। কিন্তু সাত দিনের মাথায় কাবিন নামার ১০ লাখ টাকার চেক দিয়ে আমায় ডিভোর্স লেটার পাঠায় শশুর বাড়ি থেকে।
আমি সিনথি কে থামিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম “কেনো”?
কারন আম্মুর ধবল রোগ আছে। সাথে আমারো নাকি আছে৷ আমার বৃদ্ধা আঙুলে ছোট্ট একটা সাদা দাগের মতো আছে৷ এটাই নাকি কারন। ভবিষ্যৎ-এ আমার সন্তানেরও একিই অবস্থা হবে৷ তাই সে ডিভোর্স দিয়ে দিয়েছে।
আমি বললাম মগের মুল্লুক নাকি? আপনারা থানায় যান নি?
সিনথি উত্তর দিলো সব কিছুই করেছি। তারা উলটো অভিযোগ করেছে, আমাদের মা মেয়ের ধবল রোগ আছে আমরা সেটা তাদের কাছে গোপন রেখেছি।
বিয়েটা আব্বুর পছন্দে হয়েছিলো। বিয়ের ৭ দিনের মাথায় এভাবে ডিভোর্স হয়ে যাওয়ায় আব্বু ভেঙে পড়ে খুব। আসলে আমায় খুব ভালোবাসতো তো। তার এক সপ্তাহের মধ্যে আব্বু ব্রেইন স্টোক করে, ওখান থেকে আর রিকভার হয়নি, মারা যায়।
এমন সিচুয়াশনে ঠিক কেমন শান্তনা দিতে হয় কিংবা কি বলতে হয় আমি ঠিক জানিনা। আমি চুপ থাকলাম। রাতের অন্ধকারে প্রিয়জন হারানোর যন্ত্রনা দ্বিগুণ হয়ে জ্বালায়। অন্ধকার যদি ধনুক হয়, তবে দুঃখ ধনুকের ফলার মতো। অন্ধকার যতো গভীর হয়, মানুষ ততো একা হয়। স্মৃতির বাতাসে দুঃখের ফলা এসে বুকের বা পাশে বিঁধতে থাকে এলোপাথাড়ি। খুব সম্ভবত একারনেই গভীর রাতে শহর জুড়ে দুঃখ পোষা মানুষের নিরব জোয়ার হয় নিভৃতে, নির্জনে! এ মেয়েটা এতোটা কষ্ট নিয়ে কিভাবে আছে? কতো রাত সে দুঃখের ধনুকের ফলায় আহত হয়ে নির্ঘুম কাটিয়েছে? আমি ঘোরে পড়ে যাই।
সিনথির জন্য এই মুহূর্তে আমার কষ্ট হচ্ছে। চাপা কষ্ট নিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম “চেকটা” কি করেছেন? সিনথি বললো রেখে দিয়েছি। আমি যখন স্বাবলম্বী হবো তখন চেকটাকে নিজের হাতে পুড়াবো। জানেন আব্বু মারা যাওয়ার পর আমরা খুব অসহায় হয়ে যাই। ঢাকায় টিকতে না পেরে গ্রামে চলে যাই খরচ কম বলে। আব্বু বেচে থাকতে গ্রামে গেলে যে মানুষ গুলো আমাদের মাথায় নিয়ে নাচতো, সে মানুষ গুলোই আবার কেমন বিশ্রী হয়ে গেলো। সারাক্ষন দেখলেই কটু কথা বলতো। আমার সহ্য হতোনা। কান্না করতাম। শেষমেশ সহ্য করতে না পেরে আবার ঢাকায় আসলাম। যে বাসায় উঠেছি এটা আমার মামার বাসা। গত ৩ বছর মামা-ই আমাদের চালাচ্ছে।
খানিকটা চুপ হয়ে সিনথি বললো জানেন আপনাকে এগুলো কেনো বলেছি?
আমি বললাম “কেনো”?
আসলে পড়াশোনা শেষ হয়ে যাওয়ার পর আমার কোন বন্ধু হয়নি। আমার বিয়ে নিয়ে বাজে ঘটনার পর কোন বন্ধু বান্ধবীর সাথেও আর যোগাযোগ করিনি। নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলাম। কখনো কারো সাথে কথাই বলিনি। এখন ভাবছি নতুন করে সব শুরু করবো। মামার সাথে কথা বলেছি, উন্মুক্ত তে ভর্তি হবো। আমার একজন বন্ধু দরকার। খুব ভালো বন্ধু। যে আমায় এসবকিছু থেকে উঠে আসতে সাহায্য করবে। এভাবে থাকলে কি চলবে বলেন?
আমি উত্তর দিলাম ‘না চলবেনা’।
সিনথি বললো আজ আপনাকে দিয়ে অনেক পরিশ্রম করিয়েছি। বিনিময়ে এক গ্লাস পানিও দিতে পারিনি। সরি হুম?
বললাম না না ঠিক আছে। আমি কিন্তু পারিশ্রমিক পেয়েই কাজ করেছিলাম!
অবাক হয়ে সিনথি বললো মানে? উত্তর দিলাম প্রথম দেখেই আপনি যখন হাসি দিয়ে থ্যাঙ্কিউ বলেছেন ওটাই ছিলো আমার পারিশ্রমিক!
সিনথি এবার হাসলো। এই হাসিটা আমি দেখতে পাচ্ছি না। তবে চেষ্টা করছি অন্তর চোখ দিয়ে দেখার। সিনথির হাসি ভাবতে ভাবতে আমার মনে হলো, জীবন কেমন উদ্ভুত! কেউ কেউ জন্মদিন পালনের জন্য তাক লাগানো অনুষ্ঠান করে আবার কেউ কেউ জন্ম নিয়ে শুধু বেঁচে থাকার জন্য প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে! আহ নিয়তি! আহা জীবন! স্বাদের জীবন।
বিঃদ্রঃ গল্পের সিনথি চরিত্রের ঘটনাটা আমার এক স্টুডেন্টের সাথে ঘটে যাওয়া সত্য ঘটনা অবলম্বনে। ব্যাপারটা গল্পের স্বার্থে আমি আমার মতো লিখেছি। এই শহরে বেঁচে থাকা প্রতিটা মানুষ ভিন্ন ভিন্ন গল্প পুষে। মন নামক ডায়েরিতে দেখানো যাবে না চাদরে সেগুলোকে আগলে রাখে। মাঝে মাঝে কেউ কেউ তা প্রকাশ করে, অন্যথায় গল্পগুলো দীর্ঘশ্বাসের চাপে জীবনের সাথে বেঁচে থাকে স্মৃতি হয়ে। তবে থাকে, প্রতিটা মানুষের বলার মতো একটা গল্প থাকে।
লেখক: তাসফীর ইসলাম (ইমরান)
শিক্ষার্থী: সার্ভে ইঞ্জিনিয়ারিং, বাংলাদেশ সার্ভে প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয়।