শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ, ১৪৩১
লুৎফা বেগম।।
করোনা মহামারির এক সকাল। আমি ভীষণ ব্যস্ত- খবু ভোরে ঘুম থেকে ওঠে নাশতা তৈরি, ছেলেকে স্কুলে পাঠানোর জন্য প্রস্তুত করা এবং নিজেও রেডি হওয়া। নিজের স্কুল ছুটির পর ছেলেকে স্কুল থেকে আনা, গোসল করানো, খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানোসহ বিভিন্ন কাজের মধ্যেই নিজের স্কুলের কাজ থাকলে বিকেলে তা সারতে হয়। এভাবেই দারুণ ব্যতিব্যস্ততার মধ্য দিয়ে বিকেল গড়িয়ে যায়।
হঠাৎ করে করোনা মহামারির কারণে লকডাউন! এই ধরনের কঠিন পরিস্থিতির জন্য আমি, আমার পরিবার বা কেউ প্রস্তুত ছিল না। অপ্রিয় সত্য হলেও বলতে দ্বিধা নেই, শুরুর দিকে আমরা খুব খুশি ছিলাম। কারণ এত বড় পরিসরে ছুটি কখনও পাওয়া যায় না। দিন যত গড়াতে লাগল পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নিল। চলাফেরায় কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও ঘরবন্দি থাকার মধ্যে পরিচিত-অপরিচিত অনেকের মৃত্যুর খবর শুনে ভারাক্রান্ত হলাম। মহামারি পরিস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি দিন দিন বেড়েই চলেছে। এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুরা। তাদের মানসিক বিকাশ চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাদের জীবন মানেই চার দেয়ালের মাঝে দিন কাটানো চিড়িয়াখানার বন্দি পাখির মতো। কী দুর্বিষহ!
এভাবেই চলছে দিন। আমি কোমলমতী শিশুদের শিক্ষক। মহামারির মধ্যে পড়া আদরের শিশুদের খোঁজ-খবর নেওয়া জরুরি বোধ করি। সেই তাগিদ থেকে এবং অভিভাবকদের উৎকণ্ঠার জায়গা থেকে প্রতিদিনই ফোনে কথা হয়। শিশুদের নিয়ে উদ্বেগে থাকা অভিভাবকরা জানাতে লাগলেন, আপা, বাচ্চা তো কথা শুনতে চায় না। পড়তে বসানো আরও কঠিন হয়ে পড়ছে। আপা, ছেলেটা বড্ড একরোখা হয়ে যাচ্ছে। আবার কেউ বলেন, বাসায় বাচ্চা একাকিত্ব বোধ করছে, ওর সঙ্গে খেলার মতো কেউ নেই। এ ধরনের কত কথা আসতে লাগল।
টেলিভিশন, সংবাদপত্র ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কথা হচ্ছে। এ ব্যাপারে অভিভাবকদের সচেতনতা বাড়াতে কিছু বিজ্ঞাপনও দেখা যাচ্ছে। বলা হচ্ছে, শিশুদের বেশি বেশি সময় দিতে হবে, তাদের হাসিখুশি রাখতে হবে, নিয়ন করে পড়াশোনা করাতে ও খাওয়াতে হবে। অর্থাৎ বাসা বা বাড়িতে থাকা শিশুদের জন্য একটি রুটিন করা এবং তা অনুসরণ করা। এটি কী যথেষ্ট! ধরুন, শিক্ষক হিসেবে এই মহামারির মধ্যে আমিও একটি রুটিন তৈরি করলাম। যেমন- ঘুম থেকে ওঠে সকালের নাশতা করা, হাতের লিখন, অনলাইন ক্লাসে অংশ নেওয়া, খেলা করা বা ড্রইং করা, গোসল সেরে দুপুরের খাবার গ্রহণ করা। পারলে দুপুরে একটু ঘুমিয়ে নেওয়া, ওঠে বিকেলের নাশতা করা, সুযোগ থাকলে খেলা করা বা গল্প করা, সন্ধ্যায় পড়তে বসা ও সবশেষে ঘুম পাড়া।
এবার মূল কথায় আসা যাক। উল্লিখিত রুটিন তো যে কেউ তৈরি করতে পারেন। তবে তা অনুসরণ করাই বড় চ্যালেঞ্জ। এর জন্য সবচেয়ে বেশি জরুরি হলো শিশুদের পাশে অভিভাবকদের উপস্থিতি। এখানে বাঁধছে বিপত্তি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তো খোলা। অর্থাৎ শুধু শিশুদেরই ছুটি, অন্য সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত। কর্মজীবী মা ছাড়াও যারা গৃহিণী মা, তারাও বাসার কাজ নিয়ে এতটাই ব্যস্ত থাকেন যে, কাজ গুছিয়ে উঠতেই তারা অস্থির হয়ে যান। অফিস থেকে ফিরে বা বাসার কাজ শেষে শিশুদের সঙ্গে সময় কাটাতে অনেকে বিরক্ত হয়ে ওঠেন। এই হলো আমাদের বাস্তবতা।
হ্যাঁ, এত কিছুর মাঝেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত আমাদের ভালো থাকতে হবে। স্বামী, সন্তান ও পরিবার নিয়েই সেই ভালো থাকার আয়োজন করতে হবে। আমরা কেউ জানি না, কবে, কীভাবে পরিস্থিতি আগের মতো হবে, আগের মতো স্কুলে যেতে পারবে শিশুরা! আবার কখন শিশুদের কোলাহলে মুখর হবে বিদ্যাপীঠ। এই না-জানা সময়ে যত কষ্টই হোক, শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে সর্বোচ্চ খেয়াল দিতে হবে। সব সময়ই লক্ষ্য রাখতে হবে, কোনোভাবেই শিশু যেন ট্রমায় না পড়ে। এছাড়া শিশুর আচার-আচরণে অস্বাভাবিক কিছু দেখলে অবশ্যই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, করোনা চিরদিন থাকবে না, জীবন থাকবে; ভবিষ্যৎ থাকবে। আমাদের ভবিষ্যৎ আমাদের শিশুরা। মহামারির মধ্যেই যত্নে গড়ে বেড়ে উঠুক আমাদের সন্তানরা।
লেখক: লুৎফা বেগম, প্রধান শিক্ষক, অগ্নি শিখা পাবলিক স্কুল।