শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ, ১৪৩১
লাইফস্টাইল ডেস্ক।।
প্রাচীনকাল থেকেই চিকিৎসা ক্ষেত্রের নানা বিপর্যয়কে পরাজিত করে বিজ্ঞানের আবিষ্কারগুলো আমাদের জীবনযাত্রাকে সহজতর করেছে। উন্নত চিকিৎসা বিজ্ঞানের কল্যাণে বহু জটিল রোগের নিরাময়ের সন্ধান খুঁজে রোগাক্রান্ত ব্যক্তিকে নতুন জীবনের আলো দেখিয়েছে। কিন্তু বর্তমানে সেই চিকিৎসা বিজ্ঞানকে এক কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করেছে করোনা ভাইরাস। করোনা ভাইরাসের আগ্রাসনে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্ব এক আতঙ্কের মধ্যে দিয়ে সময় অতিবাহিত করছে। ইতিমধ্যেই করোনার ছোবলে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে হয়েছে অনেককেই। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভাইরাসটি মানুষের দেহকোষের ভেতরে মিউটেট করছে অর্থাৎ গঠনগত পরিবর্তন এনে নতুন রূপ নিচ্ছে, যা ক্রমেই বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। সাধারণত যে ব্যক্তিটি করোনা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, যার আইসিইউ সাপোর্ট প্রয়োজন হয়েছে কিংবা মৃদু উপসর্গ নিয়ে বাসায় চিকিৎসা গ্রহণ করেছেন, করোনা থেকে সেরে ওঠার পরও তার মধ্যে যদি সেই উপসর্গ গুলো থাকে এবং তার সঙ্গে অন্যান্য নতুন উপসর্গ দেখা দেয়, তাহলে এগুলোকে বলা হয় করোনা-পরবর্তী জটিলতা।
পোস্ট কোভিড সিন্ড্রোম (করোনা-পরবর্তী জটিলতা) তখনই বলা হয়, যখন করোনা পজিটিভ বা করোনা আক্রান্ত হওয়ার ১৪-২১ দিন পরও তার বিভিন্ন ধরনের উপসর্গ শরীরে অবস্থান করে। করোনা-পরবর্তী জটিলতাসমূহ তিন-চার মাস পযর্ন্তও দীর্ঘায়িত হতে পারে। করোনা-পরবর্তী জটিলতা ব্যক্তিবিশেষে ভিন্নতর হতে পারে। সেক্ষেত্রে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনাও ভিন্ন হবে। করোনা-পরবর্তী জটিলতা সমূহ :
মারাত্মক দুর্বলতা: করোনা থেকে সেরে ওঠার পরও রোগীদের মধ্যে যেই সমস্যাটি সব থেকে বেশি দেখা যায়, তা হলো প্রচণ্ড বা মারাত্মক দুর্বলতা। অনেকে অল্প হাঁটাচলা বা অল্প পরিশ্রমেই অনেক বেশি দুর্বলতা অনুভব করেন। সেক্ষেত্রে পর্যাপ্ত বিশ্রাম, খাদ্যাভাসে পরিবর্তন, ভিটামিনযুক্ত খাবার ও প্রোটিন জাতীয় খাবার করোনা-পরবর্তী শরীর পুনর্গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। খাবারের পাশাপাশি চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী মাল্টিভিটামিন জাতীয় ওষুধ খাওয়া যেতে পারে।
ঘুমের সমস্যা: করোনা আক্রান্ত হওয়ার পর থেকেই রোগীদের মধ্যে ঘুমের সমস্যা দেখা দিতে থাকে (কাশি, চিন্তা ও অন্যান্য কারণে)। পরবর্তীতে করোনা নেগেটিভ হওয়ার পরও রোগীরা নিদ্রাহীনতায় ভুগেন। প্রতিদিন নিদিষ্ট সময় করে ঘুমাতে যাওয়া, রাতে ঘুমের আগে নিয়ম মেনে সহনীয় মাত্রায় অল্প ব্যায়াম করে ঘুমাতে যাওয়া ও চিকিৎসকের পরার্মশ অনুযায়ী ঘুমের ওষুধ সেবন ঘুুমের সমস্যা থেকে মুক্তিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
চুল পড়ে যাওয়া: করোনা-পরবর্তী জটিলতায় পুরুষ ও মহিলা উভয়ের ক্ষেত্রেই (অনেকের মধ্যেই) চুল পড়ার সমস্যাটি দেখা দেয়। এক্ষেত্রে ভিটামিন ‘ই’ জাতীয় ক্যাপসুল, বায়োটিন সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তবে চুল পড়া সমস্যা দেখা দিলে দ্রুত একজন চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হওয়া প্রয়োজন।
স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়া: করোনা-পরবর্তী সময় অনেকেই স্বল্প সময়ের স্মৃতি ভুলে যাওয়া কিংবা পূর্বের অনেক কথাই সঠিকভাবে স্মরণ করতে না পারা—এ ধরনের জটিলতায় ভুগছেন। এক্ষেত্রে পূর্ণ বিশ্রাম, অবসর সময়ে বিনোদন, পারিবারিক সৌহার্দপূর্ণ অবস্থান ও নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে পূর্বের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাওয়া সম্ভব।
শ্বাসতন্ত্রের জটিলতা: শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া, শ্বাস আটকে আটকে যাওয়া, বুকে চাপ ধরে থাকা কিংবা মৃদু কাশি—মূলত শ্বাসতন্ত্রের এই সমস্যাগুলোই বেশি দেখা যায়। এক্ষেত্রে ফুসফুসের সাধারণ ব্যায়াম অর্থাত্ নাক দিয়ে নিঃশ্বাস নিয়ে ৭-১০ সেকেন্ড ধরে রেখে মুখ দিয়ে শ্বাস বের করা—এই ব্যায়ামটি শ্বাসতন্ত্রের জটিলতায় সাময়িক প্রশান্তি দেবে। এছাড়া যারা ধূমপায়ী, তাদের সম্পূর্ণরূপে ধূমপান পরিহার করতে হবে।
হার্টের সমস্যা: এক বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে, করোনা আক্রান্ত হবার পর প্রায় ৬০-৮০ ভাগ রোগীর হৃদপণ্ড করোনা দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বুকে এক ধরনের চাপা ব্যথা অনুভব করা, বুক ধরফর করা, অল্পতেই হাঁপিয়ে যাওয়া, শ্বাসকষ্ট, এই ধরনের উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত এক জন হূদেরাগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে।
মস্তিষ্কের সমস্যা: মাথা ব্যথা, দুশ্চিন্তা, ব্রেন স্ট্রোকসহ মস্তিষ্কের সমস্যাও করোনার-পরবর্তী জটিলতা হিসেবে দেখা দিতে পারে।
খাবারে অরুচি, গ্যাসের সমস্যা, অ্যালার্জির সমস্যাগুলোসহ নতুন নতুন কিছু জটিলতা বর্তমান সময়ে দেখা যাচ্ছে। যাদের ধুলাবালি ও খাবারে অ্যালার্জির সমস্যা রয়েছে, তাদের ধুলাবালি থেকে বাঁচতে মাস্ক ব্যবহার করা ও অ্যালার্জি জাতীয় খাবার পরিহার করতে হবে। শ্বাসতন্ত্রের সমস্যায় শ্বাসতন্ত্রের ব্যয়ামের সঙ্গে স্পাইরোমিটার সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তবে স্পাইরোমিটারের ব্যবহার পদ্ধতি সঠিকভাবে জেনে এটি ব্যবহার করা যেতে পারে।
এছাড়া যারা ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপজনিত জটিলতায় দীর্ঘদিন ধরে ভুগছেন, তাদের ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
করোনা-পরবর্তী জটিলতা এড়াতে রোগীকে অবশ্যই উপরি উক্ত বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখতে হবে। রোগীর নির্দিষ্ট সময় পর পর ফলোআপ নিশ্চিত করতে হবে, তবে উপর্সগ জটিল আকার ধারণ করলে দ্রুত চিকিৎসক ও হাসপাতালের শরণাপন্ন হতে হবে। নিয়মিত ফলোআপের মাধ্যমে করোনা-পরবর্তী জটিলতা অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব। করোনা-পরবর্তী জটিলতা থেকে মুক্তি পেতে সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।