শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ, ১৪৩১
রিয়াদ মাহমুদ সিকদার, কাউখালী (পিরোজপুর) ॥
পিরোজপুরের কাউখালীর শীতল পাটির ঐতিহ্য অনেক পুরোনো। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পাঠ্য বই হইতে ও পিরোজপুরের পরিচিতিতে শীতল পাটির কথা উল্লেখ থাকত। কিন্তু পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে পাটি বুনিয়েদের সংখ্যা কমে যাওয়ায় এবং শীতল পাটি তৈরীর প্রধান কাঁচামাল পাইত্রা ধ্বংসের কারনে কাউখালীর ঐতিহ্যবাহী পাটি হারিয়ে যেতে বসেছে। পিরোজপুরের কাউখালী উপজেলার সুবিদপুর গ্রাম এক সময় ছিল শীতল পাটির তৈরীর প্রধান ঘাটি। পাইত্রা উৎপাদন, রক্ষনাবেক্ষন করে পাটি তৈরী হতো বলে এলাকার নাম ‘পাটিয়াল পাড়া’ আর পাটি উৎপাদনের নাম ‘পাটিকর’।
এ গ্রামের অধিকাংশ নারী পুরুষ শীতল পাটি উৎপাদনে জড়িত ছিল। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং ১৯৪৭ এ দেশ বিভাগের পর পাটিকর সম্প্রদায়ের বড় অংশ দেশ ছেড়ে চলে যায়। যারা দেশের মায়া ত্যাগ করতে পারেনি ১৯৭১ সালে, তারা পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়। বর্তমানে প্রায় ২৫-৩০ টির মতো পরিবার এ গ্রামের শীতল পাটির ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। এক সময় এ গ্রামে প্রায় তিনশ একর পাইত্রা বন ছিল। বনের বেশীর ভাগই উধাও হয়ে গেছে। বর্তমানে ৩৫-৪০ একর জমিতে পাইত্রা বন আছে। এ ছাড়া উপজেলার পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকেও পাইত্রা সংগ্রহ করে থাকেন এ এলাকার পাটিকররা। শীতল পাটির হিমেল পরশে শরীর জুড়ানোর জন্য মানুষের আগ্রহ সামান্যটুকু হ্রাস পায়নি। অর্থাভাবে পাইত্রা চাষ ও আগের মতো নেই। সুপটু পাটি বুনিয়েদের সংখ্যাও কমে গেছে। কালের স্বাক্ষী যেসব পাটিয়াল এখন ও বেঁচে আছেন তাদের কর্মক্ষমতা প্রায় ফুরিয়ে গেছে। নতুনভাবে দক্ষ কারিগর তৈরী হয়নি। অনেকে পাটি বানানোর কাজ ছেড়ে দিয়েছে।
এ কুটির শিল্পের বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতার ও অনুকুল পরিবেশ না থাকায় স্বল্প পুজির পাটিয়ালরা পেশা ধরে রাখতে পারেনি। রবিন পাটিকর, ধলা পাটিকর, মহারানী পাটিকর, রঞ্জন পাটিকর , অনিল পাটিকর , গোবিন্দ পাটিকর, রমা পাটিকর প্রমূখ পাটিয়ালদের মতে, এ কারনেই মূলত তাদের রুটি রুজির পথ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তাদের সহায়তার জন্য তারা কিছু দাবী দাওয়া পেশ করেন। এর মধ্যে রয়েছে, পাটিকরদের পূর্ণবাসন, সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করা, পাইত্রা চাষ বাড়ানো, পাটির ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করা, দখল হয়ে যাওয়া পাটি শিল্প সমবায় সমিতি ভবন সম্প্রসারন করা ইত্যাদি। অন্যদিকে স্বাধীনতার আগে সুবিদপুর গ্রামে তিনশ থেকে সাড়ে তিনশত একর জমিতে পাইত্রা চাষ হতো।
বর্তমানে তা ৩৫ থেকে ৪০ একরে এসে ঠেকেছে। পাইত্রা গাছ একবার বপন করলে আর বপন করার দরকার হয় না। নিচু বা উচু যে কোন জমিতে এর আবাদ হয়ে থাকে। এখানকার পাটি শিল্পে নিয়োজিত শিল্পীরা তাদের আর্থিক সমস্যার কারনে কম মূল্যে জমি বিক্রি করে দিচ্ছে প্রভাবশালীদের কাছে। প্রভাবশালীরা পাইত্রা বাগান কেটে ধান চাষ করে বা ঘরবাড়ি তৈরী করে। এর ফলে এলাকায় পাইত্রা বন ক্রমেই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এ প্রক্রিয়ায় পাটিয়ালরা পাইত্রার অভাবে পাটি বোনা বন্ধ করে অন্য পেশায় চলে যায়। পাটি শিল্প এবং এর সংগে যুক্তদের সমস্যা সমাধান করার জন্য নেই ঋণ সুবিধা। ফলে তারা তাদের জমি বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে।
পাটিকরদের কয়েকজন জানান, তাদের উন্নত প্রশিক্ষণ এবং তৈরী পাটির সঠিক মূল্য নিশ্চিত করা ও ব্যাংক বা এনজিওর মাধ্যমে সহজ শর্তে ঋণ দিলে তারা এ পেশা টিকিয়ে রাখতে এবং পাইত্রা চাষ বাড়াতে সক্ষম হবে। এশিয়া, ইউরোপ ও ্আমেরিকায় প্রবাসী বাংলাদেশীদের পাশাপাশি বিদেশীদের কাছে শীতল পাটির কদর দিন দিন বৃদ্ধি পেয়েছে।
স্থানীয় শীতল পাটি উন্নয়ণ প্রকল্প সমিতির নেতা ব্রজেন্দ্র লাল পাটিকর বলেন, পাইকাররা এসে আমাদের পাটি কিনে নিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থান ও বিদেশে পাঠাচ্ছে। কিন্তু আমরা এর মূল্য পাচ্ছি অত্যন্ত কম। সরকার যদি এই শিল্পটাকে রপ্তানীকারক পন্য হিসাবে স্বীকৃতি দিত তাহলে আমরা এর সঠিক মূল্য পেতাম। আর সরকার অনেক রাজস্ব পেত।
এ প্রসঙ্গে উপজেলা চেয়ারম্যান আবু সাঈদ মিয়া মনু বলেন এই ঐহিত্যবাহী শিল্পকে বাচিয়ে রাখার দায়িত্ব আমাদের সকলের। তাদের দাবী দাওয়া নিয়ে আমি উধ্বর্তন কর্তৃপক্ষের সাথে শ্রীঘ্রই আলাপ করবো।