শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ, ১৪৩১
আশুক আহমদ।।
ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় দুটো ধর্মীয় উৎসবের দ্বিতীয়টি ঈদুল আযহা বা কুরবানির ঈদ নামে পরিচিত। ঈদুল আযহা মূলত আরবি বাক্যাংশ যার অর্থ হলো ‘ত্যাগের উৎসব’। ইসলামি চান্দ্র পঞ্জিকায়, ঈদুল আযহা জ্বিলহজ্জের ১০ তারিখে পড়ে। আন্তর্জাতিক (গ্রেগরীয়) পঞ্জিকায় তারিখ প্রতি বছর ভিন্ন হয়, সাধারণত এক বছর থেকে আরেক বছর ১০ বা ১১ দিন করে কমতে থাকে। ঈদের তারিখ স্থানীয়ভাবে জ্বিলহজ্জ মাসের চাঁদ দেখার ওপর নির্ভর করে। হিজরি বর্ষপঞ্জি হিসাবে জিলহজ্জ্ব মাসের ১০ তারিখ থেকে শুরু করে ১২ তারিখ পর্যন্ত ৩ দিন ধরে ঈদুল আজহার কুরবানি চলে। হিজরি চান্দ্র বছরের গণনা অনুযায়ী ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আজহার মাঝে ২ মাস ১০ দিন ব্যবধান থাকে। দিনের হিসেবে যা সর্বোচ্চ ৭০ দিন হতে পারে। এ বছরের ঈদুল আযহা আগামী ১ আগস্ট বাংলাদেশে উদযাপিত হবে।
ঈদুল আযহার বিশেষত্ব হলোঃ
ঈদুল আযহার জামায়াতে নামায আদায় করা এবং নামায পরে পশু কুরবানি। ঈদের দিন একটি সুবৃহৎ এলাকার মুসলমানগণ এক সাথে মিলে জামায়াতের সাথে মহান আল্লাহকে রুকু করে সিজদা দেয় যা দেখে আল্লাহপাক ভীষণ খুশি হন। নামায শেষে সকল ভেদাভেদ ভুলে একে অপরের বুকে বুক মিলিয়ে সারা বছর জমে ওঠা হিংসা-বিদ্বেষ গ্লানি মুছে ফেলার মহা সুযোগ লাভ করে। সামাজিক অনেক সমস্যার সহজ সমাধানের মাধ্যমে শান্তি-শৃঙ্খলা, সৌহার্দ্য ও পরস্পরের প্রতি সহানুভূতির সৃষ্টি হয়।
এ দিনে মুসলমানেরা ফযরের নামাযের পর ঈদগাহে গিয়ে দুই রাক্বাত ঈদুল আযহার নামাজ আদায় করে ও অব্যবহিত পরে স্ব-স্ব আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষ ও উট আল্লাহর নামে কোরবানি করে। ইসলামের বিভিন্ন বর্ণনা অনুযায়ী, মহান আল্লাহ তা’আলা ইসলামের রাসুল হযরত ইব্রাহীম (আ.) কে স্বপ্নযোগে তার সবচেয়ে প্রিয় বস্তুটি কুরবানি করার নির্দেশ দেন: “তুমি তোমার প্রিয় বস্তু আল্লাহর নামে কোরবানি কর।”
ইব্রাহীম (আঃ) স্বপ্নে এমন আদেশ পেয়ে ১০টি উট কোরবানি করলেন। পুনরায় তিনি আবারো একই স্বপ্ন দেখলেন। অতঃপর ইব্রাহীম (আঃ) এবার ১০০টি উট কোরবানি করেন। এরপরেও তিনি একই স্বপ্ন দেখে ভাবলেন, আমার কাছে তো এ মুহূর্তে প্রিয় পুত্র ইসমাইল (আ.) ছাড়া আর কোনো প্রিয় বস্তু নেই। তখন তিনি পুত্রকে কোরবানির উদ্দেশ্যে প্রস্তুতিসহ আরাফাতের ময়দানের উদ্দেশে যাত্রা করেন। এ সময় শয়তান আল্লাহর আদেশ পালন করা থেকে বিরত করার জন্য ইব্রাহীম (আঃ) ও তার পরিবারকে প্রলুব্ধ করেছিল, এবং ইব্রাহীম (আঃ) শয়তানকে পাথর ছুঁড়ে মেরেছিলেন। এ ঘটনার স্মরণে হজ্জের সময় শয়তানের অবস্থানের চিহ্ন স্বরূপ নির্মিত ৩টি স্তম্ভে প্রতীকী পাথর নিক্ষেপ করা হয়। যখন ইব্রাহীম (আঃ) আরাফাত পর্বতের উপর তার পুত্রকে কোরবানি দেয়ার জন্য গলদেশে ছুরি চালানোর চেষ্টা করেন, তখন তিনি বিস্মিত হয়ে দেখেন যে তার পুত্রের পরিবর্তে একটি প্রাণী কোরবানি হয়েছে এবং তার পুত্রের কোনো ক্ষতি হয়নি। ইব্রাহীম (আঃ) আল্লাহর আদেশ পালন করার দ্বারা কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
এই ঘটনাকে স্মরণ করে সারা বিশ্বের মুসলিমরা আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য প্রতি বছর এই দিবসটি উদযাপন করে।
তাকওয়া অর্জন ছাড়া আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায় না। একজন মুসলিমের অন্যতম চাওয়া হলো আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য অর্জন। পশুর রক্ত প্রবাহিত করার মাধ্যমে কুরবানী দাতা আল্লাহ রাব্বুল আল আমিনের নৈকট্য অর্জন করেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘আল্লাহর নিকট পৌঁছায় না তাদের গোশত এবং রক্ত, বরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া। এভাবে তিনি এগুলোকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন যাতে তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর এজন্য যে, তিনি তোমাদের পথ-প্রদর্শন করেছেন; সুতরাং আপনি সুসংবাদ দিন সৎকর্মপরায়ণদেরকে। [সূরা আল-হাজ্জ: ৩৭]
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, কুরবানির দিন কোনো ব্যক্তি রক্ত ঝরানোর তুলনায় আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয় ও পছন্দনীয় অন্য কোনো কাজই করতে পারে না। যবেহ করা জন্তু কিয়ামতের দিন তার শিং, পশম ও খুর নিয়ে উপস্থিত হবে। কুরবানির রক্ত মাটিতে পড়ার পূর্বেই আল্লাহর নিকট সন্তুষ্টির মর্যাদায় পৌঁছে যায়। অতএব, তোমরা তাতে মনের সুখ সন্তোষ নিবদ্ধ কর। (তিরমিযী, ইবনে মাজাহ)
কুরবানির মধ্যেও দুটি মহা কল্যাণকর দিক নিহিত রয়েছে। ১. আল্লাহর রাজি খুশি অর্জনের দ্বারা গুনাহ মাফ। ২. আত্মীয়-স্বজন ও অভাবী মানুষের খোঁজ-খবর নেয়া। তাদের সাথে প্রাণ খুলে মিশার পরিবেশ তৈরি হয়।
আল্লাহ বলেছেন, কুরবানির গোশত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না। পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া। কুরবানিদাতা আল্লাহর নির্দেশ পালনে নিজের অর্থ খরচ করে পশু কিনে বা অর্থ খরচ করে পশু পালন করে নির্দ্বিধায় আল্লাহর উদ্দেশ্যে তা কুরবানি করে। আল্লাহর হুকুমের কাছে এই মাথানত করাই তার তাকওয়া।
অতিমাত্রায় সর্তকতা অবলম্বনের সাথে সাথে কিছু বিষয় পরিহার করতে হবে। কুরবানী হবে শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি উদ্দেশ্যে, অর্থের উৎস হতে হবে বৈধ। আর এগুলো সকল ইবাদত কবুলের ও শর্ত। কুরবানী হতে হবে মনের ঐকান্তিক আগ্রহ সহকারে শুধুমাত্র আল্লাহর আদেশ পালন, ইব্রাহীম নবীর সুন্নতের অনুসরণ অনুকরণের বাস্তব নমুনা হিসাবে ইসলামী শরীয়ার একটি বিধান পালনের নিমিত্তে। এ দুটি বিষয়ের অনুপস্থিতিতে অথবা দুটির একটির অনুপস্থিতিতে কুরবানী বা অন্য যে কোন নেক কাজ ইবাদত আল্লাহর দরবারে কবুল হবে না বরং লোক দেখানো পর্যায়ে চলে যাবে আর লোক দেখানো যে কোন ইবাদত শিরক,যা আল্লাহ মাফ করবেন না বলে ঘোষণা করেছেন পবিত্র কুরআনে।
যে কোন ভাল কাজ ইবাদত বন্দেগী ও কুরবানী কবুলের প্রথম এবং পূর্ব শর্ত নিয়তের এবং অর্থের বিশুদ্ধতা। অবৈধ অর্থের দান-সদকা, হজ্জ, মসজিদ- মাদ্রাসা নির্মাণ, কুরবানী কোন বিষয়ই কবুল হয় না। ভাগাভাগি করে কুরবানির অংশীদার নির্বাচনের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে যেহেতু কুরবানী আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিলের জন্য তাই এখানে সকলের ইখলাছ যদি এক রকম হয় না অর্থাৎ শরীকদের কোন এক জনের নিয়তে অন্য কোন উদ্দেশ্য থাকলে বাকী সকলের কুরবানী বাতিল হয়ে যাবে।
অনেকে বাজার হতে পশু ক্রয় করে মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করে নানা কলা কৌশলে ট্যাক্স ফাকিঁ দিতে চায় যা মোটেই ঠিক নয়, অনুচিত কারণ, কুরবানি একটি ইবাদত। কুরবানীর পশু কেনার সময় লোক দেখানোর জন্য প্রতিযোগিতা পরিহার করা উচিত। অন্যের চেয়ে বেশি দামের বা বড় সাইজের পশু না কিনলে নিজের প্রেস্টিজ রক্ষা করা যাবে না অথবা সমাজের মানুষ কি বলবে এমন মানসিকতা পরিহার আবশ্যক।
পশু কেনার পর পশুর সাথে সেল্ফি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করা হয় যা দেখে অনেকে বিরূপ মন্তব্য করে। এ জাতীয় ছবি প্রকাশ লোক দেখানোর নামান্তর।
অধুনা আরেকটি বিষয় পরিলক্ষিত হয় কুরবানির দিন পশু জবেহ করার অথবা জবেহ করার পর মাংস কাটাকাটির দৃশ্যের স্থির চিএ বা ভিডিও ফেসবুকে আপলোড করা হয়, দেখে মনে হয় যেন উনারা যে কুরবানী করছেন কিয়ামত দিবসে তার প্রমান হিসেবে ছবি বা ভিডিও উপস্থাপন করবেন।
জবেহ করার দৃশ্য কোনভাবেই পাবলিক প্লেসে প্রকাশ করা উচিত নয়, এতে একদিকে ‘রিয়া’ বা লোক দেখানোর দোষে কুরবানি কবুল না ও হতে পারে অন্যদিকে রক্তপাতের দৃশ্য দেখে বাচ্চা বা দুর্বলচিত্তের মানুষ ভয় পেয়ে শারীরিক অসুবিধায় পড়তে পারে। আমাদের ছোট্ট একটি ভুলের কারনে সম্পূর্নরুপে বাতিল হয়ে যেতে পারে আমাদের অত্যন্ত যত্নের সাথে আদায়কৃত আল্লাহর মহান হুকুম কুরবানী, পশু কুরবানি না হয়ে হবে পশু হত্যা। পশু জবাই করার পর একটি ছোট তীক্ষ্ণ ছুরি দ্বারা খোঁচা দেয়ার একটা সিস্টেমের সাথে আমরা কমবেশি প্রায় সবাই পরিচিত, আমাদের অনেকেরই ধারনা এই কাজ করলে পশু দ্রুত মারা যায় এবং কষ্ট কম পায়। আর এই একটা ভুলই আমাদের কুরবানী বাতিলের জন্য যথেষ্ট।
পশু জবাই করার সঠিক পদ্ধতি হল, পশুর অন্তত মূল তিনটি রগ কেটে দেয়া। আর মূল তিনটি রগ কেটে দিলে, রক্তক্ষরনের ফলস্বরুপ স্বাভাবিকভাবে পশুটি খুব দ্রুত মারা যায়। কিন্তু আমরা একটু অতিরিক্ত তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে, পশুটার মেরুদন্ডের ভেতর তীক্ষ্ণ ছুড়ি ঢুকিয়ে “মেরুরজ্জু বা স্পাইনাল কর্ড” বিচ্ছিন্ন করে দ্রুত মেরে ফেলার চেষ্টা করি। স্পাইনাল কর্ড বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে পশুর মস্তিষ্ক, দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় আর এর ফলে পশুটি হার্ট এটাক করে এবং মারা যায়। এতে পশুটি জবাই না হয়ে, হত্যা হিসেবে পরিগনিত হয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতেও এই পন্থা অত্যন্ত গর্হিত এবং বিপদজনক। স্পাইনাল কর্ড কেঁটে গেলে পশুর দেহের মাংশপেশিতেই রক্ত জমাট বেঁধে যায় এবং ফলশ্রুতিতে মাংস দূষিত হতে পরে। এই মাংস আহারে বিভিন্ন জটিল রোগ সৃষ্টি হতে পারে। বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে, মাত্র কয়েক মিনিট বাঁচাতে গিয়ে যেন আমাদের কুরবানী বরবাদ না হয়।
আল্লাহর কুরবানির গোশত বা পশুর রক্তের প্রয়োজন নেই। তিনি দেখতে চান বান্দার অন্তরে আল্লাহর প্রতি প্রেম, ভয় ও ভক্তি।
কুরবানীর শেষে পরিবেশ যাতে দূষিত না হয় এ বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। পশুর রক্ত মাটি দ্বারা ঢেকে দেয়া, ময়লা, আবর্জনা সরিয়ে ফেলা একান্ত প্রয়োজন । সর্বোপরি করোনার এ মহাদুর্যোগকালে পশু ক্রয়-বিক্রয় থেকে শুরু করে কুরবানির মাংস বন্টনসহ সকল কর্মকাণ্ডে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে সম্পন্ন করতে হবে।
কুরবানির নিয়ম-কানুন সম্পর্কে আমরা অবশ্যই ইসলামিক স্কলারদের কাছ থেকে জেনে নিয়ে এ ইবাদত সম্পন্ন করব।
কুরবানির মাধ্যমে মুসলিম সমাজে প্রেম-প্রীতি, একতা এবং সংহতি বৃদ্ধি হোক। পৃথিবী হোক সবধরনের ভাইরাস মুক্ত। বনের পশুর সাথে সাথে মনের পশুও কুরবানির হোক।
লেখক: প্রধান শিক্ষক, দক্ষিণভাগ এনসিএম উচ্চ বিদ্যালয়
বড়লেখা, মৌলভীবাজার।