শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র, ১৪৩০
তালতলী প্রতিনিধি।।
বরগুনার সাগর পাড়ের রাখাইন নারী তাঁতীদের উৎপাদিত চাদর, শার্ট পিস, ব্যাগ, শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা প্রভৃতি বস্ত্রের কদর দক্ষিণাঞ্চলসহ দেশের সর্বত্রই রয়েছে। মিয়ানমার থেকে আমদানি করা বিভিন্ন রঙ বে-রঙয়ের সুতা দিয়ে হস্তচালিত তাঁতে তৈরী রাখাইনদের কারুকাজ খচিত বস্ত্রের চাহিদা সারা বছর খুব বেশি না থাকলেও শীত মওসুম ও ঈদে ব্যাপক চাহিদা দেখা যায়।
শীত মৌসুম। সকাল, বিকেল ও রাতের ঠাণ্ডা শীতের আগমনী বার্তা দিচ্ছে উপকূলের মানুষকে। শীতের আগমণে বরগুনার রাখাইন তাঁতিদেরও, ব্যস্ততা বাড়ছে কাপড় বোনায়।
কাপড় বুননের জন্য বেড়ে গেছে তালতলীর রাখাইন পাড়ায় নারীদের কর্মব্যস্ততা। বছরের অধিকাংশ অলস সময় কাটালেও রাখাইন নারীদের এ কর্মব্যস্ততায় তারা কষ্টের পরিবর্তে আনন্দও পায়। একারনে পাড়ায় পাড়ায় তাঁতিদের কোলাহল আর কর্মব্যস্ততার পাশাপাশি বেড়েছে মনের আনন্দও। আর চোখে মুখে দেখা গেছে হাঁসির ঝিলিক।
তাঁতিদের তাঁতে বিভিন্ন ধরনের কাপড় বুননের খটখট শব্দে মুখরিত হয়ে উঠেছে তাঁত সমৃদ্ধ রাখাইনদের এই জনপদ তালতলীর রাখাইন পাড়াগুলো। বার্মা থেকে আমদানীকৃত সুতা দিয়ে শীতের চাদর, শার্ট পিচ, ব্যাগ, শাড়ি, লুঙ্গি, ও গামছা বুনে তাঁতিরা তাদের হস্তচালিত তাঁত বস্ত্রের উৎপাদন বৃদ্ধিতে নিরলস ভাবে পরিশ্রম করে যাচ্ছে। রাখাইন তাঁতীদের উৎপাদিত এ সকল বস্ত্রেরই কদর দক্ষিনাঞ্চল সহ দেশের সর্বত্রই রয়েছে। রাখাইনদের হস্তচালিত তাঁতে বিভিন্ন রং বেরঙ্গের সুতা দিয়ে তৈরি লতা পাতা ফুল ও বিভিন্ন কারু কাজে গড়া এ সকল তাঁত বস্ত্র যেন সকলের কাছে প্রিয়। সারা বছর এ সকল বস্ত্রের পুরো চাহিদা না থাকলেও শীত মৌসুম, রমজানের ঈদ ও কোরবানীতে ব্যাপক চাহিদা দেখা যায়। আর সেই চাহিদার কথা মাথায় রেখেই তাঁতীরা তাঁত কাপড় বুনন কাজে ব্যস্ত। তাদের কর্মব্যস্ততায় সরগরম হয়ে উঠেছে তালতলীর তাঁতীদের রাখাইন পাড়াগুলো। আগাঠাকুর পাড়ার উসিট মং জানান, তালতলীর বড়বগী ইউনিয়নের তালতলী পাড়া, ছাতন পাড়া, মনুখে পাড়া, আগাঠাকুর পাড়া, নিশানবাড়ীয়া ইউনিয়নের সওদাগর পাড়া, তালুকদার পাড়া ও সোনাকাটা ইউনিয়নের কবিরাজ পাড়া, নামিষে পাড়া, লাউ পাড়া ও অংকুজান পাড়ার রাখাইন পল্লীতে ১২ থেকে ১৪টি করে শতাধিক হস্তচালিত তাঁত রয়েছে। কোন কোন পাড়ায় একই পরিবারে ২-৩টিও তাঁত রয়েছে।
বিংশ শতাব্দীর পূর্বে তালতলীর এ তিনটি ইউনিয়নে প্রায় অর্ধশত রাখাইন পাড়া ছিল। এবং প্রতিটি পাড়ায়ই ব্যাঙ্গের ছাতার মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল অসংখ্য তাঁত কারখানা। তখন কারখানা গুলোতে বস্ত্র উৎপাদনের কাজ চলতো পুরোদমে। আর সে কালে তাঁত বস্ত্রের উপরই নির্ভর ছিল পুরো রাখাইন পরিবার। সে সময় রাখাইন পরিবারের মধ্যে এমন প্রচলন ছিল, যে মেয়েরা হস্তচালিত তাঁত শিল্পের কাজ না জানতো সে মেয়ের বিয়েও হত না। আজ আর সে প্রচলন নেই রাখাইরদের মধ্যে। তখন তাঁত পরিচালনার কাঁচা মালের অভাব ও ছিল খুব বেশী। বার্মা থেকে আনা তাঁতের সুতোসহ সকল কাঁচা মালের খরচ মিটিয়ে যা বিক্রি হত তাঁতে অনেক সময় প্রায়ই লোকসান দিতে হত তাঁতীদের। এমনি ভাবে তাঁতীরা এ তাঁত বস্ত্র উৎপাদন করতে গিয়ে সারা বছর ঋণে জর্জরিত হয়ে যায়। লোকসান গুনতে গুনতে প্রায় নিঃস্ব হয়ে যায় তাঁতীরা। কালক্রমে ঝিমিয়ে পড়ে তালতলীর রাখাইন তাঁত শিল্প।
এমনিভাবে রাখাইনদের ঐতিহ্যবাহী তাঁত শিল্প প্রায় বিলীন হওয়ার উপক্রম হয়ে পড়েছে। অনেক রাখাইন সমপ্রদায় লোকসান দিতে দিতে তাদের জমি জমা বিক্রি করে নিঃস্ব হয়ে যাওয়ার কারনে দেশ ত্যাগ করে বার্মা চলে গেছেন। আর কিছু কিছু রাখাইন পল্লীতে পিতৃপেশা হিসাবে হস্তচালিত তাঁতের কারখানা এখনও চালু রেখেছে। সেই সমস্ত রাখাইন নারী-পুরুষ তাঁতীরা সামনে শীত মৌসুমের কারনে ক্রেতাদের চাহিদা মেটানোর জন্য এবং নিজেদের বাড়তি আয়ের আশায় দিন রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে মহা ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। বর্তমানে তাঁতের মৌসুম না হলেও শীত মৌসুমের কারনে বাড়তি আয় হবে মনে করে ঝিমিয়ে পড়া তাঁতীরা আবার সচল হয়ে উঠেছে। অতিরিক্ত পরিশ্রমেও ক্লান্তি বোধ করছেন না তারা। রাখাইন সম্প্রদায়ের তাঁত কারখানায় লতা পাতা ফুল ফল ও প্রানী জগতের কারু কাজে তৈরী তাঁত বস্ত্র তালতলী শহরের অনেক দোকান পাটে পাওয়া যাচ্ছে। রাখাইনদের তাঁত বস্ত্র ক্রয় করতে দূর দুরান্ত থেকে অনেকে আসেন এখানে। এগুলো সকল সমপ্রদায়রা সৌখিন হিসাবে ক্রয় করে কেহ নিজে ব্যবহার করে আবার কেউবা উপঢৌকন হিসাবে প্রিয়জনকে উপহার দেয়। উপহার দেয় উপরস্থদের নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্যও।