শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ, ১৪৩১
গোলাম কিবরিয়া, বরগুনা।।
উপকূলীয় বরগুনা জেলার তালতলীর একটি গ্রামের নাম বেহেলা। এখানে প্রতিবছর শীত মৌসুমের শুরুতেই গোল গাছিদের রস সংগ্রহে বদলে যায় গ্রামটির চিত্র। প্রতিদিন সকাল থেকে সংগ্রহ চলে গোলের রস। পরে শুরু হয় গুড় তৈরির কর্মযজ্ঞ। আর এই গোল গুড় যাচ্ছেন পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে।
শীত মৌসুমের প্রায় চারমাস কর্মসংস্থান দুই হাজার গাছির ও তাদের পরিবারের। এতেই জীবিকা চলছে এসব পরিবারের। বরগুনা জেলার তালতলীর বেহেলা গ্রামের এই গোল রসের গুড় এখন সীমানা ছাড়িয়ে যাচ্ছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে।
এতে গ্রামীণ অর্থনীতির মোড় ঘুরে যাচ্ছে এই গ্রামটির। তবে গাছিদের দাবী রয়েছে প্রশিক্ষণ ও গুড় সরকারিভাবে বাজারজাতকরণ করার সহযোগিতা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, বরগুনার তালতলী উপজেলায় ৯০ হেক্টর জমিতে গোল গাছের সংখ্যা প্রায় ২০ হাজার। এসব গোল গাছের বাহর থেকে সংগৃহীত রস জ্বালিয়ে প্রতি শীতে প্রায় ১০ হাজার টনেরও বেশি গুড় উৎপাদিত হয়।
সবচেয়ে বেশি গাছ আছে বেহেলা গ্রামে। গ্রামটিতে গোল গাছের সংখ্যা ১৫ হাজার। এরপর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গাছ রয়েছে গেন্ডামারা গ্রামে। এটিসহ উপজেলার অন্যান্য আরো কয়েকটি গ্রাম মিলিয়ে রয়েছে আরো পাঁচ হাজারেরমতো গাছ।
স্থানীয়ভাবে গোলের বাগানকে বলা হয় ‘বাহর’। বেহেলার গোল বাহরে কাজ করে প্রায় পাঁচশত গোল চাষি। এই গ্রামে গোলের বাহর রয়েছে দুই হাজার প্রায়। শীতে এসব গাছ হয়ে ওঠে গাছিদের কর্মসংস্থানের উৎস। একজন গাছি প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৪০০টি গাছের রস আহরণ করতে পারেন। বর্তমানে রস সংগ্রহে ব্যস্ত সময় পার করছেন তারা।
গোলের বাহর (বাগান) রয়েছে চার হাজার প্রায়। শীতে এসব গাছ হয়ে ওঠে গাছিদের কর্মসংস্থানের উৎস। একজন গাছি প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৪০০ গোল গাছের রস আহরণ করতে পারেন। বর্তমানে রস সংগ্রহে এই গ্রামটিতে ৩০০ জন গাছির ব্যস্ত সময় কাটছে।
জানা যায়, শীত মৌসুমকে সামনে রেখে গাছিরা নভেম্বর মাস থেকে ফেব্রুয়ারির শেষ সময় পর্যন্ত গোল গাছগুলো কেটে রস সংগ্রহের উপযোগী সময়। শীতের তীব্রতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে গোল গাছের রস ঝরা শুরু হলে তারা খরচা কমানোর জন্য প্লাস্টিকের পাত্র বসিয়ে সেই রস সংগ্রহ করেন। শীত যত তীব্র হয় এই রসের চাহিদাও তত বেড়ে যায়। শীতকালীন এ কয়েক মাসে গোল রস ও গুড় বিক্রি করে লাখ টাকাও আয় করেন তারা। গোলোর এ রস প্রতি কলস ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা ও গুড় প্রতি কেজি ১০০ টাকা থেকে ১৫০ টাকায় বিক্রি হয়। এক কলস রস দিয়ে ৩ কেজি গুড় তৈরি হয়। এজন্যই এক কলস রস ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা বিক্রি করা হয়।
এদিকে এই গ্রামের গোলের গুড় চলে যায় পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে। সেখানেও এর চাহিদা রয়েছে অনেক। তবে গাছিরা চাচ্ছে সরকারিভাবে তাদের গোলের গুড়গুলো বিদেশে গেলে আরও ভালো দাম পাবেন।
বেহেলা গ্রামের সমির জানান, আমার ৩০০ গাছ আছে এগুলো নিজেই কেটে রস সংগ্রহ করে তারপর গুড় তৈরি করে গ্রামে বিক্রি করি । আমি পরিষ্কার পরিছন্ন ভাবে গুড় তৈরি করাতে শীতকালীন এ সময়ে প্রচুর অর্ডার পাই। প্রতি কলস রস ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর গুড় বিক্রি হচ্ছে প্রতিকেজি ১০০ থেকে ১৫০ টাকা করে। আমার যে ৩০০ গাছ থেকে প্রায় ৮ কলস রস হয় এতে প্রতিদিন গড়ে দুই হাজার টাকার গুড় আসে।
একই গ্রামের বাদল বলেন, এই গোল গাছগুলো বাঁচিয়ে রাখার জন্য ঘের কেটে আমাদের ভাটা-জোয়ারের লবণ পানি রাখা হয়।
একই গ্রামের মহিলা গাছি চামেলি বলেন, এই মৌসুমে যে গোলের রস পাই তাতে ধান চাষের চেয়ে গোলের রস ও গুড়ে আয় বেশি। ৩৩ শতাশং জমিতে যে পরিমাণ ধান চাষ হয় তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি হয় গোলের গুড়ে। এজন্য আমরা ধান চাষ রেখে গোল চাষে আগ্রহী হয়েছি। এতে করের আমাদের পরিবারের অর্থনীতির অবস্থা অনেক ভালো হয়েছে।
চাষি লাল চন্দ্র বলেন, আমাদের এলাকার গোলের গুড় পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে পাঠানো হয়। আমাদের আত্মীয়-স্বজনদের সুবাদে সেখানে ( ভারত) কিছু বিক্রি করা হয়। তবে সরকারি ভাবে যদি বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হতো তাহলে আমরা আরও লাভবান হতে পারতাম।
এ বিষয়ে তালতলী উপজেলা কৃষি অফিসার রেজাউল করিম বলেন, আমাদের কাছে গোল গাছের সঠিক তথ্য নেই, এছাড়াও গোল গাছ নিয়ে কৃষি বিভাগের কোনো কাজও নেই। আমরা মাঠ কৃষকদের নিয়ে কাজ করে থাকি। তবে এই গোলের গুড়ের সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে গোলপাতাকে গবেষণার মাধ্যমে গোল গাছ চাষিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হলে এটা খুব কাজে লাগবে। আমার দপ্তর থেকে কৃষি মন্ত্রনালয়ে খুব দ্রুত একটি প্রস্তাব পাঠানো হবে।