শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র, ১৪৩০
মো. ইউনুছ শরীফ, ভোলা।।
বাংলাদেশ নামক এ ভূ-খন্ডকে “স্বাধীন” করতে যে বীর যোদ্ধারা জাতির মাথা উচু করে রেখেছেন, তাদের একজন ভোলা জেলার কৃতি সন্তান বীর শ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল। ভোলার দৌলতখান উপজেলার হাজিপুর ইউনিয়নে ১৯৪৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তার জন্ম। বাবা মো. হাবিবুর রহমান ছিলেন সেনা বাহিনীর হাবিলদার, মাতা মালেকা বেগম গৃহীনি। বাবার চাকুরীর সুবাধে জন্মের পর থেকেই তার শৈশব কাটে মা-বাবার সাথে কুমিল্লা সেনানিবাসে।
শৈশব: কুমিল্লা সেনানিবাসেই তার চোখে ভেসে আসে বাবা ও বাবার সহযোদ্ধাদের সু-শৃঙ্খল পরিবেশ। পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র থাকা অবস্থায় সেনাবাহিনীর কর্মকান্ডের সাথে মোস্তফা কামালের ভালোবাসা হয়ে যায়। স্বপ্ন দেখতে থাকেন সেও একদিন বাবার মতো সেনাবাহীনির (সৈনিক) হবে।
সেনাবাহীনিতে যোগদান: মোস্তফা কামাল ছোট বেলা থেকেই ছিলেন, চৌকস ও সাহসী। পঞ্চম শ্রেণি পাশ করার পরপরই ১৯৬৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর যোগ দেন পাকিস্তান সেনাবাহীনিতে। কঠোর প্রশিক্ষণ শেষে ১৯৬৮ সালে নিয়োগ লাভ করেন চতুর্থ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। ওই সময়ই পাকিস্তানীদের শোষণ আর নিপিড়নে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে দেশ, শুরু হয় গণআন্দেলন। ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে সারা দেশে। সেই সাথে তারাও দেশকে শত্রুমুক্ত করতে ঝাপিয়ে পড়ে পাকিস্তানীদের ওপর। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ।
মুক্তিযুদ্ধে মোস্তাফা কামাল: ২৫ শে মার্চ চড়মভাবে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়, তখন মোস্তফা কামাল কর্তব্যরত ছিলেন ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া। ওইসময় ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অস্থায়ী কার্যালয় ছিল আখাউড়া। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই চতুর্থ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট পাকিস্তানী বাহিনী ত্যাগ করে মুক্তি আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়েন। যেসব বাঙ্গালী সৈনিক পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন তাদের মধ্যে মোস্তফা কামাল অন্যতম। শত্রুর আক্রমন প্রতিহত করার জন্য ২নং প্লাটুনকে দায়িত্ব দেয়া হয় বঙ্গোপসাগরের উত্তরে দরুইন গ্রামে। মোস্তফা কামাল ওই প্লাটুনের একজন চৌকস সৈনিক ছিলেন। ১৮ এপ্রিল ১৯৭১ যুদ্ধ চড়মে। চারিদিকে অস্ত্রের ঝনঝনানী। দরুইনের দিকে এগিয়ে আসছে পাকিস্তানী বাহিনী। মুক্তি যোদ্ধাদের হাতে ভাড়ী অস্ত্র না থাকায় তারা এগুতে পারছে না। ইতোমধ্যে গুলিবিদ্ধ হতে শুরু করেছে মুক্তি যোদ্ধারা। অস্ত্র তুলে নিলেন মোস্তফা কামাল। শত্রু মোকাবিলায় টিকে থাকতে না পেরে আত্মরক্ষার জন্য অধিনায়কসহ সবাই পিছু হটলেন। কিন্তু তিনি জানতেন সে পিছু হটলে তার শত্রুরা তার সঙ্গীদের ধাওয়া করবে। মোস্তফা কামালের অসীম সাহসের কারনেই সে বারের মতো বেঁচে গিয়ে শত্রুদের পরাস্ত করতে সক্ষম হলে। শত্রুরা পিছু হটে চুপ থাকলো না। অন্যদিক দিয়ে হামলা চালাতে শুরু কলো। ঘিরে ফেললো মোস্তফা কামালকে। তিনি জানতেন তার মৃত্যু অবধারিত। তার পরেও তিনি সাহস হারালেন না এবং আত্ম সমর্পণও করলেণ না। যতক্ষন পর্যন্ত তার জ্ঞান ছিল তৎক্ষন পর্যন্ত বাঘের মতো গর্জন দিয়ে তিনি গুলি চালিয়ে গেলেন। ১৯৭১ এর ১৮ এপ্রিল তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। তার জীবনের বিনীময়ে বেচে গেলো সেনাবাহীনির একটি কোম্পানী, তার অগনিত সহযোদ্ধা। জাতী পেল একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। আর তাই তার এ শহীদের মধ্য দিয়ে অমর হয়ে রইলেন বীর যোদ্ধা মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল। বাংলার মানুষকে ঋণী করে দিয়ে যায় লাল সবুজের পতাকায়।
সমাধী স্থান: ঢাকায় সমাহীত করার প্রস্তাব থাকলেও স্থানীয়দের আন্তরিক দাবির মুখে, তার শহীদ হওয়ার স্থান কুমিল্লার আখাউড়া থানার ভ্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার দরুণ গ্রামেই তাকে সমাহিত করা হয়।
পারিবারিক জীবন: দেশের জন্য জীবন দেয়ার আগেই ১৯৬৮ সালে ২০ বছর বয়সে মোস্তফা কামাল একই উপজেলার মেদুয়া ইউনিয়নের হাদিস ভূইয়ার কণ্যা পেয়ারা বেগমকে বিয়ে করেন। তাদের ঘরে আলো হয়ে এসেছিল মোশারেফ হেসেন বাচ্চু। স্ত্রী আর ছোট অবুজ সন্তান ব্চ্চুকে অসহায় রেখে দেশকে হানাদার মুক্ত করতে যুদ্ধে প্রাণ দিয়ে জাতীকে এনে দেন একটি পতাক।
বীর শ্রেষ্ঠের উত্তরসূরী ও পূর্বসূরীদের অবস্থা: মাস্তফা কামাল শহীদ হলে পরিবারের সকল দায়িত্ব পূর্বেও ন্যায় বাবা হাবিলদার হাবিবুর রহমানের কাধেঁ পড়ে। স্ত্রী মালেকা বেগম, ছেলে মোস্তাফিজুর রহমান, তিন মেয়ে জাহানারা, হাসনেআরা ও হোসনে আরাকে নিয়ে চলতে থাকে জীবন। ইতোমধ্যে তার বসত বাড়িটি নদীতে বিলীন হয়ে যায়। তৎকালীন সরকার ১৯৮২ সালে ভোলা সদর উপজেলার আলীনগড় ইউনিয়নের মৌটুিিপ গ্রামে থাকার মতো সুযোগ করে দেন। সংসারের বোঝা আর সন্তানের শোককে মাথায় নিয়ে ২০০৫ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ইন্তেকাল করেন এ সৈনিক। বর্তমান বাড়ির পাশেই সমাহিত করা হয় তাকে।
বীর শ্রেষ্ঠের একমাত্র উত্তসূরী মোশারেফ হোসেন বাচ্চুও বাবা ও দাদার দেশপ্রেমে অনুপ্রানিত হয়ে দেশের সেবা করতে ১৯৯৫ সালে যোগ দেন বাংলাদেশ সেনা বাহিনীতে। ইনটেলিজেন্ট সৈনিক হিসেবে তাকে জাতি সংঘের শান্তি রক্ষি বাহীনির সদস্য হিসেবে সরকার কুয়েত পাঠান। এর আগে ১৯৮৮ সালে খুলনার তুতপাড়ার পারভীন আক্তার মুক্তিকে বিয়ে করে জীবন সঙ্গী করেন। কুয়েতে দায়িত্ব পালন কালে দূরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে ২০০৪ সালে চিরদিনের জন্য বিদায় নেন বাচ্চু। খুলনার শেরে বাংলা রোডে সাহিত করা হয় তাকে। তার দুই কন্যসন্তান তুলি ও অনামিকা মিলি। এক বছর পর প্রথম কন্যা তুলি মারা যায়। দ্বিতীয় কন্যা মিলি মা পারভীন আকতারের সাথে খুলনার তুতপাড়ায় বসবাস করতো। বীর শ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালের গর্বিত মা মালেকা বেগম জিবীত আছেন। একমাত্র ভাই মো. মোস্তাফিজুর রহমান ও দুই বোন হাসনেআরা এবং হোসনেআরা।
কেমন আছেন পরিবারের সদস্যরা: বীরশ্রেষ্ঠের মা মালেকা বেগম জানান, সন্তান ও স্বামীর মৃত্যুর পর শুরু হয় তার বেচে থাকার তৃতীয় যুদ্ধ। ছেলে মোস্তাফিজুর রহমান, নাতী-নাতনীসহ ছয় সদস্যের কেউ খোজ রাখেন না। দৈন্যতা আর অসুস্থ্যতার মধ্যে কাটছে তার জীবন। অর্থাভাবে হচ্ছে না চিকিৎসা। সরকারের পক্ষ থেকে নির্ধারিত যে সন্মানী দেয়া তা দিয়ে খাবার বা চিকিৎসা কোনটাই আর চলে না। ছেলে মোস্তাফিজুর রহমান দীর্ঘ দিন ভাইয়ের নামে প্রতিষ্ঠিত ঢাকায় বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তাফা কামাল ষ্টেডিয়ামে মাষ্টার রোলে চাকুরী করতেন। সরকারী করণের আশায় সামান্য বেতনেও দীর্ঘ দিন চাকুরিটি ধরে রাখেন। মা বার বার চেষ্টা করেও চাকুরি সরকারি করতে নাপারায় ক্ষোভে চাকুরী ছেড়ে দেন। অপরদিকে বড় মেয়ের মৃত্যুর পর সে ঘরের নাতি নাতনী, অন্য দুই মেয়ের জামাই নাতী নাতনির যোগ্যতার আলোকে কোন উপার্জনের ব্যাবস্থা করতে পারেননি। এ কারনে তাদেরকেও মাঝে মাঝে দেখাশুনা করতে হয়। এ অবস্থায় মা মালেকা বেগমকে দেখাশুনা করার একমাত্র ছেলে বেকার। নিজের চিকিৎসাসহ সংসার পরিচালনায় হাপিয়ে উঠছেন তিনি।
বীর শ্রেষ্ঠ মোস্তফা গ্রন্থাগার ও স্মৃতি যাদুঘর: বীর শ্রেষ্ঠের বাড়ির পাশে আলী নগরে ২০০৮ সালে তৈরী করা হয় বীর শ্রেষ্ঠ মোস্তফা গ্রন্থাগার ও স্মৃতি যাদুঘর। বীরের পরিবারের সদস্য হয়ে বাড়ির পাশে চাচার নামে হওয়া গ্রন্থাগার ও স্মৃতি যাদুঘরে মাষ্টার রোলে চাকুরী করে দাদীকে নিয়ে মানবেতর জীবন যাপওনের পর ২০১৯ সালে চাচার নামের কলেজে কর্মসংস্থানের ব্যাবস্থা হয় সেলিমের। সেলিম জানান, জাতীয় সশস্র বাহীনি দিবসে দাদীকে নিয়ে ঢাকায় যাওয়ার পর সুখ দুঃখ শুনা হয় এবং লিখাও হয়। কিন্তু চলে আসার পর আর কোন খোঁজ নেই। সরকারের কাছে বেশী কিছু নয়, বীরের পরিবারের সদস্যদের যোগ্যতা অনুযায়ী দাদীকে নিয়ে বাচার মত বাবা ও ভাইদের একটা স্থায়ী উপার্জনের ব্যাবস্থার আশা করছেন সেলিম।
বীর শ্রেষ্ঠের নামে প্রতিষ্ঠান: তৎকালীন মন্ত্রী নাজিউর রহমান মঞ্জু’র তৈরী করা বীর শ্রেষ্ঠে মোাস্তফা কামাল বাস টার্মিনালটির বেহাল দশা। ২০১৯ সালের বিশেষ এমপিও’র মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় আলীনগড়ে বীর শ্রেষ্ঠ মোাস্তফা কামাল মহাবিদ্যালয়। দৌলতখানে উপজেলা অডিটরিয়াম তৈরির সময় নাম দেয়া হয় বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল অডিটরিয়াম। কিন্তু একটি কুচক্রি মহলের অসুভ দৃষ্টিতে এখন লিখা রয়েছে দৌলতখান অডিটরিয়াম।
এসব প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনার বিষয়ে বীরশেষ্ঠ মোস্তফা কামালের মা ও তার পরিবারের অভিযোগ, সরকার ও কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারনেই বীরশ্রেষ্ঠের নামের এসব প্রতিষ্ঠনগুলোর বেহাল দশা। সঠিক তত্ত্বাবধানের মাধ্যমে এবং বীর শ্রেষ্ঠের জন্মবার্ষিকী, মৃত্যুবার্ষিকী ও সভা-সামেেবশের মাধ্যমে এ বীরকে নতুন প্রজন্মের কাছে আরো পরিচিত করে তুলে ধরার দাবি পরিবারের।