শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র, ১৪৩০
সেখ মুজাহিদুল ইসলাম।।
আমি নারী, একজনের কণ্যা, কারো ভাবী আর সন্তানের মা। এতগুলো পরিচয় থাকা সত্ব্যেও গত ৭ তারিখে কলাবাগানের ডলফিন গলিতে ধর্ষণ করে হত্যা করা হলো ১৭ বছরের তরুণীকে। এই ঘটনায় বিস্মিত বা অবাক হইনি একটুও। কারণ প্রতিদিন টিভি ও খবরের পাতায় চোখ রাখলে শিশু, নারী, কিশোরীর ধর্ষণের ওলাশের ছবি দেখছি।
একসময় এসব দেখে ও শুনে আতংকিত হয়ে রাতে দুচোখের পাতা এক করতে পারতাম না। হতাশ ও বিমূর্ষ হতাম সকল নারীজাতির কথা ভেবে। কিন্তু এখন এই শব্দটা এত পরিচিত আর প্রতিদিন দেখে ও শুনে অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে, মনে হয় এটা প্রতিদিন ডাল ভাতের মত নৈমিত্তিক ঘটনা।
বিষে ভরা একটি অসহনীয় সময় নিয়ে ২০২০সাল বিদায় হলো। আমরা ভেবেছিলাম ২০২১ নতুন বছর অনেক প্রত্যাশা, উন্নয়ন শান্তি ও নিরাপত্তায় এগিয়ে নিয়ে যাবে দেশ ও দেশের মানুষকে। কিন্তু করোনা কবলিত একটা মহামারীর ভেতর দিয়ে আমরা কোন উদিত সকালে উপনিত হলাম। আতঙ্কিত বছরের শুরুতেই ঘটে গেলো নির্মম ঘটনা।
৭ জানুয়ারিতে মাস্টারমাইন্ড স্কুলের এক শিক্ষার্থীকে গুরুপ স্টাডির কথা বলে বাসায় ডেকে নিয়ে ধর্ষণ ও মৃত্যু ঘটায়। এ ঘটনায় কান্না থেমে গেছে, কিন্তু হইনি একটুও আতংকিত! শুধু অবাক ও বিস্মিত হয়েছি। কিছু বাক্য, কিছু শব্দের উচ্চারণে। ঘটনার পর থেকে আপত শিক্ষিত নামের কিছু মূর্খ ইতরলোকের মানষিক অবস্থান দেখে।
বিজ্ঞ এই গুণিজনেরা চোখে আঙুল দিয়ে বোঝাতে চাইছেন মেয়েটি যেহেতু ১৭/১৮ বছরের। সেই হেতু যথেষ্ট বড় এবং প্রেমের সম্পর্কের পথ ধরেই স্বেচ্ছায় শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়েছে। এই যুক্তির ফাঁদে উনারা মাথা থেকে ধর্ষণ শব্দটি বাদ দিয়ে বার বার স্বেচ্ছায় এবং স্বেচ্ছায় কাজটি করাতে ছেলেটি ধর্ষণের দায়ে পড়ে না বা অভিযুক্ত নয়, এই কথাটি বুখাতে চেয়েছেন।
আপনাদের কাছে আমার প্রশ্ন? স্বেচ্ছায় ধর্ষণ ইচ্ছা মাথা থেকে বাদ দিয়ে যদি সুস্থ ভাবে চিন্তা করেন, তাহলে উত্তরটা পেয়ে যাবেন। যেখানে বৈধভাবে বিবাহিত স্বামী স্ত্রী হলে ও স্ত্রীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে স্বামী যদি যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হয় সেটা ও কিন্তু ধর্ষন। যা আইনে বার বার উল্লেখ করা হয়েছে।
আর সেখানে আপনারা বারবার স্বেচ্ছা শারীরিক সম্পর্কের কথা বলছেন, কিন্তু সেটা যদি আনন্দদায়ক না হয়ে কষ্টকর হয়। তাহলে কন্টিনিউ করবে না কোন পক্ষই।
আমার মনে হয়, যে বা যিনি এবং যারা বৈধ সম্পর্কগুলোতে দিনের পর দিন ব্যক্তিগত জীবনে এভাবে জোর করে এমন ভয়ংকর কান্ড ঘটিয়েছেন, কেবল তারাই এসব অবান্তর প্রশ্ন রাখেন বলে মনে হয়। ইতিমধ্যে অনেকেই দিহানের পক্ষ নিয়ে কথা বলেছেন, কিন্তু কেন বলতে পারেন?কোন আবেগে বা বিবেকে এসব কথা উঠছে।
কারো মতে মেয়েটির বয়স ১৭, কারোমতে ১৮, কারো মতে ১৯ সেই হেতু যথেষ্ট শারীরিক সম্পর্কের পরিপক্কতা তার হয়েছে।একটি স্বেচ্ছায় সম্পর্ক হজম করার মতো। একবার ভেবে দেখুন তো! অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ কখন হয় জানেন আপনারা? মন বা ইচ্ছার বিরুদ্ধে এবং ভয়ভীতি ও জোর করে প্রবল শক্তি প্রয়োগে যা ঘঠনো হয় সেটায় হয়।
আর অসহায় মেয়েটি ভয়াবহ শারীরিক কষ্ট নিয়ে সেই পাশবিকতা মেনে নেয়।এই স্বাভাবিক চিন্তাটুকু বুঝি মাথা থেকে লোপ পেলো আপনাদের।
তাহলে কি কারনে, কিসের দক্ষতা বলে অকালে ঝরে যাওয়া মেয়েটির ধর্ষণের কারনে মৃত্যু হয়েছে বলতে এত কুন্ঠাবোধ?
সমাজ ও সভ্যতা এসব ধর্ষণকারীও মুখোশধারীদের রক্ষার কারনে, বিচারবিভাগে সুষ্ঠু তদন্ত না হওয়ার কারনে শিশু, কিশোরী ও নারী বারবার ধর্ষিত হচ্ছে।
যারা মনে করেন সব দোষ মেয়েদের, আর ধর্ষণকারী ঘটনার শিকারমাত্র।তাহলে বলবো ধর্ষণকারীদের থেকে ও আপনাদের বেশি ঘৃণা করা উচিৎ। যখন এসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাগুলো ঘটে মনে হয় সাধারণ কোন ঘটনা। আনুষ্কার মৃত্যুতে ও কিছুদিন ধর্ষণের প্রতিবাদে সারাদেশ কয়েকদিনের জন্য উত্তাল হবে, কিছুদিন মিডিয়া, ভার্চুয়াল জগৎ, আহা, হুহা করবে পথে ঘাটে চায়ের দোকানের লোকেরা, কিছুদিন প্রতিবাদ ছাত্রছাত্রীদের ও খন্ড খন্ড মানব বন্ধনে। এরপর তদন্ত কমিটি গঠন, মামলা, অতঃপর বিচার কার্য তামাদি ফাইলে বন্দী। যা একপ্রকার আমাদের সব গা সওয়া হয়ে গিয়েছে এবং এটা প্রায় সবার জানা।
এই দেশে এমন একটি দিন ও কি গিয়েছে যে টিভিতে ও সংবাদপত্রে ধর্ষণের চিত্র না দেখেছি। আর অপ্রকাশিত ধর্ষনের খবরগুলো না হয় বাদই দিলাম। ধর্ষণ এই সমাজের কাছে কেবলই ধর্ষণের শিকার নারী ও তার পরিবারের ব্যক্তিগত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানে আইন বলুন, সমাজ বলুন,বিবেক বলুন,বিচার বিভাগ বলুন কারোরই যেন কোন দায়বদ্ধতা নেই।
একবার ভেবে দেখুন শুধু ঢাকার ৫০টি থানায় ধর্ষণ ও গণধর্ষণের প্রায় ৫০০/৬০০টি মামলা রয়েছে। দেশের বাকি জেলাগুলোর ঠিক একই অবস্থা। এ থেকে বোঝা যায় ধর্ষণ এখন আর কোন অসাভাবিক ও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা নয়। এটি করোনা থেকে ও মহামারী আকার ধারণ করেছে।প্রতিটি পরিবার অসহায় ও নির্বাক হয়ে পড়ছে তাদের মেয়েদের নিয়ে।
প্রকৃতির কোন ছোবল বা প্রতিশোধ লাগছে না। মানুষ নিজেরাই নিজের ঘাতক হয়ে যাচ্ছে। সবসময় লক্ষ করলে দেখা যায় বিচারহীনতা ও অবিচারের সংস্কৃতি খুব স্বাভাবিক নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে কারনে ধর্ষনের মতো অপরাধী শাস্তি না পেয়ে অবিচারের আদর্শে বুক ফুলিয়ে কথা বলে। এটা এখন নিত্তনৈমিত্তিক কাজে পরিনত করে ফেলেছে।
ধর্ষণসহ নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংসতা অপরাধের বিরুদ্ধে দেশে কঠোর আইন থাকা সত্ত্বেও কেন ধর্ষনের প্রবনতা রোধ করা যাচ্ছে না। সেটা একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিদিন ধর্ষণের খবর প্রকাশিত হচ্ছে বা হচ্ছে না এমন সংখ্যা কত হতে পারে তা অনুমান করা না গেলে ও নিশ্চিত অনুভব করা যাচ্ছে। দিন দিন যেনো দুরারোগ্য ব্যধির মতো হয়ে উঠছে। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হলো দৈনিন্দন ও সহজে সংঘটিত অপরাধ হিসেবে ধর্ষণ আগাছার মতো বিস্তার লাভ করে চলেছে।
সবসময়ই দেখা যায় ধর্ষনের শিকার শিশু, কিশোরী ও তরুণীরাই বেশি। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও শালিশকেন্দ্রের নথি থেকে জানা যায় ১৮ বছরের নিচের মেয়েরা বেশি ধর্ষনের শিকার হচ্ছে।এদের ভেতর থেকে ৫/৬বছরের শিশুরা ও বাদ পড়ছে না। তাহলে জন্মই কি নারীর আজন্ম পাপ?
আসলে পুরুষদের একাংশের মধ্যে এহেন বিকৃত যৌন সহিংসতা যখন প্রতিনিয়ত ঘটতে থাকে। তখন যদি আইন ও নীতিনির্ধারকেরা সেই মাত্রায় উদ্বেগ গ্রহন করতেন, হয়তো বা থামাতে না পারলে ও এর এতোটা বৃদ্ধি হতো না।
প্রতিদিন ই ধর্ষণের খবর আসছে, কিন্তু প্রতিকারের কোন সাড়া নেই। যে কারনে ৫ বছরের শিশু থেকে ১১ বছরের কিশোরী, ১৮ বছরের তরুণী ধর্ষিত হলে ও সমাজ ও বিবেকের টনক ততক্ষণে নড়ে না। যতক্ষন না তারা ধর্ষকদ্বারা লোমহর্ষক পন্থায় নির্মমভাবে মৃত্যু বরন করছে।
আইন বলছে ধর্ষনের সাজা জাবজ্জীবন কারাদন্ড এবং ধর্ষণকালে হত্যায় সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড।
আইনের প্রতি শ্রদ্ধারেখে বলছি,”আইন কঠোর” এতে কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু আইন কঠোর বলে বাংলাদেশে ধর্ষন কমে যাবে তা এখনও প্রমাণিত হয়নি। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে কঠোর আইনের প্রয়োজন নেই, বরং আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা আইন প্রণয়নের মতো জরুরি ও বটে।
সভা, সমাবেসে সার্বক্ষণিক ভাবে পৃথিবীর উন্নত ও কর্মশীল দেশের উন্নয়নের কথা কাজের ক্ষেত্রে টেনে এনে জনগনকে প্রলুব্ধ করা হয়। তাদের মতো আত্মনির্ভরশীল হতে শেখানো হয়। তাহলে অন্য দেশের ধর্ষণের শাস্তির বিধানটাকে কেন আমরা অনুসরণ করছি না। পৃথিবীর অনেক দেশেই আইন প্রচালিত আছে যে, ধর্ষণকারীকে সাথে সাথে মৃত্যুদন্ড দেয় তাদের চিরায়ত আইনে।
তাই এবার আর থেমে থাকা নয় সম্মিলিত শ্লোগান এটাই হওয়া উচিৎ।
“ধর্ষক নিপাত যাক
ধর্ষক তাড়ান এই তো সময়”।
আইন বিভাগের সাথে জড়িত সকল অ্যাডভোকেট ও তদীয় কাজের সাথে যাদের সংশ্লিষ্টতা আছে। আপনারা কেও ধর্ষকের পক্ষ হয়ে আইনী লড়াইয়ে কোর্টে উঠবেন না। পাশাপাশি স্মার্টফোনের ব্যবহার ও যৌন উত্তেজক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান গুলোর উপর রাস্ট্রের নিয়ন্ত্রণ থাকা জরুরি। ভ্যাভিচার আইনের ও সংস্কার প্রয়োজন।
এ ব্যাপারে পুরুষ ও নারীর চারিত্রিক বিষয় উন্নত ও পাঠ্যপুস্তকে ধর্ষণের সচেতনতা মূলক শিক্ষার আলোকপাত করা না হলে দিনদিন এই মহামারী বেড়েই চলবে।
কাজেই প্রত্যেকটি ধর্ষণের বিচার না হওয়া অব্দি সবাইকে এর বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে থাকতে হবে পাশাপাশি নিজেদের সন্তানকে সচেতন করে গড়ে তুলতে হবে।সবাই ধর্ষককে বয়কট করুন, তাদের শাস্তির দাবী তুলুন মৃত্যুদণ্ডই এর বিধান হোক।
কেবল রাস্ট্রের একার চেষ্টাই নয়, আমাদের সম্মিলিত উদ্দ্যোগই কেবল পরিবর্তন এনে দিতে পারে। তা না হলে একদিন আমাদের এই অজ্ঞতা ও নিস্ক্রিয়তা এমন ভয়ংকর হবে যে তার ভয়াবহতা কেউ সামলে নিতে পারবে না।
লেখক: সাংবাদিক (রূপালী বার্তা)।
২৬ জানুয়ারি ২০২১
(মতামত কলামে প্রকাশিত সব লেখা একান্তই লেখকের নিজস্ব মতামত। এর সাথে পত্রিকার কোন সম্পর্ক নেই)