শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ, ১৪৩১
রূপালী স্বাস্থ্য।।
লীমা (ছদ্মনাম) বয়স ৩১। তিন বছর হলো বিয়ে হয়েছে। কলেজে পড়ান। বিয়ের পর থেকেই বেবি নেয়ার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কিন্তু বেবি কনসিভ করছে না। লীমা ভাবেন, এ মাসেই বুঝি কনসিভ করে যাবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল হয়নি। প্রতি মাসেই আশায় আশায় থাকেন। এদিকে পরিবারের অন্য যারা সদস্য আছেন, তাদেরও খুব ইচ্ছা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটা বেবি হোক। শাশুড়ি প্রায়ই জিজ্ঞেস করেন- কেন লীমা দেরি করছে? কিন্তু লীমা নিজেই চায় বেবি হোক, দেরি করবে কেন।
পরিবারের অন্যরাও নানা ধরনের মন্তব্য করেন। লীমার শারীরিক ক্রুটির কারণে যে বেবি হচ্ছে না, এটা এক রকম অলিখিতভাবে পরিবারের সবাই ধরে নিয়েছেন। একজন তো বলেই ফেললেন শুধু ছাত্রী পড়ালেই হবে, বেবি নিতে হবে না? মনটা শুধু বাইরের জগতে রাখলে চলবে? ঘর-সংসার ঠিকঠাক করতে হবে না? তোমার বয়স কি দিন দিন বাড়ছে না কমছে? এত টেনশন ছাড়া থাকো কিভাবে? আর বেশি দিন আলাদা করা কিন্তু আমাদের পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আরেক জনে তো তার সাথে তাল মিলিয়ে বলে ফেললেন, আমাদের ছেলেকে বসিয়ে রাখব নাকি? প্রয়োজনে আমরা আবার বিয়ে দেবো। বেবি আমাদের চাই। বউমা কান না দিলে কী আর করা যাবে? আমরা কিন্তু তোমাকে সতর্ক করে দিচ্ছি। আমাদের ছেলের জীবনটা নষ্ট হতে দেবো না। আরো কত কী!
লীমা নীরবে কাঁদে। হায় আল্লাহ! একি পরীক্ষায় ফেললে তুমি? লীমা এখন কী করবে? অনেক ভেবেচিন্তে স্বামীকে বলে, চলো ডাক্তারের কাছে যাই। দেখি তিনি কী বলেন? আমার মাসিক তো মাসে মাসেই নিয়মিত হয়। শারীরিক আর কোনো সমস্যা দেখছি না। এমনকি মাসিকের সময় কোনো ব্যথাও হয় না। কিন্তু লীমার স্বামী বললেন, আরো কিছু দিন দেখো। ডাক্তারের কাছে গেলেই তো একগাদা টেস্ট ধরিয়ে দেবে। আমাকে বলবে আপনার বীর্য পরীক্ষা করুন। আমি কিন্তু তোমায় পরিষ্কার বলে রাখছি আমার কোনো সমস্যা নেই। কাজেই আমি টেস্ট করতে পারবো না। আর আমার ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কী দরকার?
লীমা ভেতরে ভেতরে যারপরানাই ভেঙে পড়ে। হায় আল্লাহ! এক জীবনে এত কষ্ট কেন? কী কাঠখড় পুড়িয়ে দিনরাত বিসিএসের কোচিং করে চাকরি পেয়েছে। লিখিত পরীক্ষা, মৌখিক পরীক্ষা কত কী? তারপর আবার পোস্টিং নিয়ে কত ঝামেলা করতে হয়েছে। সব কিছু গুছিয়ে এখন যখন বেবি নেয়ার জন্য চেষ্টা করছি, তখন কী ভয়ানক অবস্থা। কেন বেবি কনসিভ হচ্ছে না? লীমার স্বামীর আবার ডায়াবেটিস আছে। কিন্তু সেটা তো মাত্রায় তত বেশি নয় এবং ওষুধেই কন্ট্রোল হচ্ছে। তাহলে সমস্যা কোথায়। সাতপাঁচ ভেবেও লীমার মনে দিশেহারা ভাব।
লীমা মায়ের সাথে শেয়ার করলে মা জোর দিয়ে বলেন ডাক্তারের কাছে যাও। কলিগ এবং নিকটস্থ মুরুব্বিরাও একই কথা বললেন। কারণ, আজকাল চিকিৎসাব্যবস্থা অনেক উন্নত হয়েছে। কোথায় কী সমস্যা আছে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলে ধরা পড়বেই। লীমা কী করবে ভেবে পায় না।
অবশেষে একদিন বিকেলে স্বামীকে বলেন, চলো আজ, ডাক্তারের কাছে যাবো। ওই ডাক্তার আমার বান্ধবীর বোন। কাজেই ভয়ের কিছু নেই। লীমা অবশেষে কলিগের সাথে ডাক্তারের কাছে যান। সব ইতিহাস শোনার পর ডাক্তার একটি তলপেটের আল্ট্রাসনোগ্রাফি এবং স্বামীর বীর্য পরীক্ষা করতে বলেন। লীমা ডাক্তারকে অনুরোধ করলেন আমার আল্ট্রাসনোগ্রাফি আজকেই করেন, কিন্তু আমার স্বামী তো তার পরীক্ষা করতেই চাইবে না। সে বলে তার কোনো সমস্যা নেই। কিভাবে আমার স্বামীর পরীক্ষা করব? কিন্তু ডাক্তার অনড়, ডাক্তার লীমাকে বলেন এই পরীক্ষায় শারীরিক কোনো সমস্যা হয় না। কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। তাহলে তিনি করবেন না কেন? বেবি তো তারও দরকার। জীবন চলার সাথে বেবি নেয়ার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে আপনার স্বামীর অবশ্যই আপনার পাশে থাকা উচিত এবং প্রয়োজনীয় একটি মাত্র পরীক্ষা অবশ্যই করা উচিত। আর এই পরীক্ষা ছাড়া কেউই শুধু মুখে মুখে ভালো আছি, এটা বলতে পারবেন না। কারণ, অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়েই শুক্রাণুর উপস্থিতি নির্ণয় করতে হয়। সেই শুক্রানুগুলোর সংখ্যা, নড়াচড়া, গঠন প্রকৃতি ঠিক আছে কিনা, নড়াচড়া স্বাভাবিক কিংবা স্বাভাবিকের চেয়ে কম কি না এসব দেখা হয়। এই বীর্য পরীক্ষা যাদেরই বেবি হতে সমস্যা হয় তাদের করা উচিত।
কারণ দেখা গেছে শতকরা ৩০-৪০ ভাগ ক্ষেত্রে বেবি না হওয়ার পেছনে স্বামীর বীর্যের সমস্যাই দায়ী। কাজেই স্বামীর পরীক্ষা করাতেই হবে। ডাক্তার আরো বলেন, আপনি স্বামীকে বোঝান, একেবারেই যদি তিনি পরীক্ষা না করতে চান, আমার কাছে নিয়ে আসুন। আমি ভালোভাবে বুঝিয়ে বলব। শেষ পর্যন্ত ডাক্তারকেই লীমার স্বামীকে বোঝাতে হয়। প্রায় এক ঘণ্টা কথা বলার পর তিনি বীর্য পরীক্ষা করতে রাজি হন। রিপোর্ট নেয়ার দিনও সেই একই অবস্থা। লীমার স্বামী আসেননি। ডাক্তারের মুখ থমথমে গম্ভীর। দেখলেন তো লীমা, সমস্যাটা আপনার স্বামীর। আপনার স্বামীর বীর্যে শুক্রাণুর সংখ্যা একেবারেই কম। যেখানে ১৫ থেকে ৫০ মিলিয়ন করে এমএল এ থাকতে হয়, সেখানে মাত্র দুই মিলিয়ন আছে। তাও আবার নড়াচড়া কম এবং শুক্রাণুর আকৃতি অস্বাভাবিক। এ অবস্থায় বেবি হবে কিভাবে? অথচ ওরা সবাই ধারণা করছে, আপনার দোষে বেবি হচ্ছে না। লীমা এসব শুনছে? লীমা নিজেও ভাবেনি রিপোর্টে এ রকম একটা কিছু আসবে।
বাসায় গিয়ে স্বামীকে বললে স্বামী বিশ্বাস করে না। উল্টো লীমাকে বকা দেয়? হায় খোদা! তুমি পথ দেখাও! লীমা যা ভেবেছিল তাই হলো। লীমার স্বামী বিশ্বাস করতে চাইলো না। বলল, কার রিপোর্ট সঠিক? সঠিকভাবে করেছে কি না এসব, পরের দিন এ রকম জোর করে লীমা স্বামীকে ডাক্তারের চেম্বারে নিয়ে গেল। ডাক্তার ছবি এঁকে দেখালেন এবং বুঝালেন। কিন্তু লীমার স্বামী তখনো বিশ্বাস করতে পারছে না। ঠিক হলো রিপোর্ট আরেকবার করা হবে। দিন সাতেক পরে আবার করা হলো। অন্য একটা নামীদামি ল্যাবে সব নিয়মকানুন মেনে (ছেলেদের বীর্য পরীক্ষার ক্ষেত্রে কিছু নিয়ম কানুন মানতে হয়)। কিন্তু একই রিপোর্ট এলো। লীমা ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে। এ রোগের কোনো চিকিৎসা নেই নাকি? লীমার স্বামীর প্রশ্ন। ডাক্তার তাকে আশ্বস্ত করলেন। দুই রকম ওষুধ দিলেন। ডায়াবেটিস অবশ্যই নিয়ন্ত্রণে রাখতে বললেন। দুই মাস পর আরেকবার টেস্ট করার কথা বললেন। ডাক্তার বললেন আশা ছেড়ে না দিতে।
লীমার শাশুড়িও বিশ্বাস করলেন না। সব দোষ লীমার। পরিবারের অন্য সদস্যরা শাশুড়ির সাথে তাল মেলালো। লীমার এখন বাসায় মনখুলে আলাপ করার মতো কোনো লোক নেই। কেউই লীমার সাথে কথা বলে না। শাশুড়ি সরাসরি বলে দিয়েছেন, আগে বেবি হোক তারপর রান্নাঘরে এসো। রান্নার সাথে বেবি হওয়ার কী সম্পর্ক লীমা বোঝে না। স্বামীও আগের চেয়ে গম্ভীর। লীমাই উদ্যোগী হয়ে স্বামীকে সহজ করার চেষ্টা করে। আমাদের প্রচলিত ধারণার একটি হচ্ছে, বেবি হওয়ার ক্ষেত্রে স্ত্রীর সমস্যাই প্রধান সমস্যা। কিন্তু মেডিক্যাল সায়েন্সে শতকরা ৩০ থেকে ৪০ ভাগ ক্ষেত্রে পুরুষের শুক্রাণুর সমস্যার জন্যও বেবি হতে সমস্যা হয়।
মেয়েরা অনেক ক্ষেত্রে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হন। স্বামীর সমস্যা থাকা সত্ত্বেও দ্বিতীয় বিয়ে করেন কিংবা হুমকি দেন। কিন্তু এই ধারণা বদলাতে হবে। স্বামী-স্ত্রী দু’জনেরই সমস্যা থাকতে পারে এটা বুঝতে হবে। স্বামীর শুক্রাণুতে সমস্যা থাকলে চিকিৎসা করাতে হবে। আজকাল অনেক ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি যুক্ত হয়েছে। মুখে আবার ওষুধের সাথে সাথে অন্য চিকিৎসাও আছে। একেবারে কোনো কিছুতে কাজ না হলেও টেস্ট টিউব বেবি শেষ ভরসা হলেও আজকাল উন্নতমান ও পদ্ধতি ব্যবহার হচ্ছে বলে সফলতার হার বেড়েছে।
সবচেয়ে সুখের কথা হলো, আমাদের দেশেই এখন এসব চিকিৎসা হচ্ছে। আপনাদের আর বিদেশ যাওয়ার প্রয়োজন পড়বে না। তবে বেবি হওয়ার সমস্যা হলে যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি চিকিৎসা নেবেন। স্ত্রীর বয়স বেশির দিকে হলে ডিম্বাণুর কার্যক্ষমতা কমে যায়। স্বামীর ক্ষেত্রেও বয়স একটি ব্যাপার। তারপরও যদি কোনো সমস্যা থাকে শুক্রানুতে সেটি দিন দিন খারাপ হতে থাকে। এ জন্য যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি চিকিৎসা নেবেন।
ডা: কে.এম. জাহিদুল ইসলাম
এমবিবিএস(ঢাকা), বিসিএস (স্বাস্থ্য)
এমএস (অর্থোপেডিক সার্জারী) অর্থোপেডিক বিশেষজ্ঞ ও সার্জন
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (পিজি হাসপাতাল) ঢাকা।