শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ, ১৪৩১
এইচ,এম, হুমায়ুন কবির, কলাপাড়া (পটুয়াখালী)।।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরুপ লীলাভুমি পর্যটনকেন্দ্র কুয়াকাটা। এখানে রয়েছে একই স্থান থেকে সুর্যোদয় ও সুর্যাস্ত দেখার পৃথিবীর একমাত্র সৈকত। সুর্যোদয় ও সুর্যাস্তের বিরল দৃশ্য অবলোকন করা যায় কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত থেকে। নয়রাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের টানে সারা বছরই পর্যটকের ভির থাকে কুয়াকাটা তবে শীতকালে বনভোজন এবং শিক্ষা সফরের শতাধিক দলসহ প্রতিদিন হাজার হাজার দেশি বিদেশি পর্যটকের সমাগম ঘটে এখানে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও সাগরের ঢেউয়ের কারনে সাগর গিলছে কুয়াকাটার জাতীয় উদ্যান। এদিকে কুয়াকাটার সৈকতের ভাঙন প্রতিরোধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় নতুন করে বাগান সৃজন ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে আগ্রহ হারাচ্ছে বন বিভাগ।
বন বিভাগের কার্যালয় সূত্র জানায়, ২০০৫ সালে সরকার কুয়াকাটায় জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করে। কুয়াকাটার বনের আয়তন ৫ হাজার ৬৬১ হেক্টর। পর্যটকদের আকর্ষণ করতে ২০০৭-০৮ অর্থবছরে প্রাকৃতিক বনসংলগ্ন সৈকতঘেঁষা ১০ হাজার হেক্টর জমিতে ঝাউবাগান গড়ে তোলা হয়।
কুয়াকাটা সৈকত লাগোয়া বনাঞ্চলে ২০১০ থেকে ২০১২ অর্থবছর পর্যন্ নতুন বাগান সৃজন করা হয়েছিল। পরে গত বছর গঙ্গামতি এলাকায় ৪০ হেক্টর ভূমিতে ঝাউবাগান করা হয়।
বন বিভাগের মহিপুর রেঞ্জ সুত্রে জানা গেছে, কুয়াকাটা সৈকত লাগোয়া বনাঞ্চলে ২০১০ থেকে ২০১২ অর্থবছর পর্যন্ত নতুন বাগান সৃজন করা হয়েছিল। গত বছর গঙ্গামতি এলাকায় ৪০ হেক্টর ভূমিতে ঝাউবাগান করা হয়। কুয়াকাটা সৈকতে ২৫ হেক্টর ভূমিতে আকাশমণিগাছের বাগান ও ২০ হেক্টর ভূমিতে ফলের বাগান করা হয়। এ ছাড়া চলতি বছর খাজুরা এলাকায় ১০ হেক্টর ও গঙ্গামতি এলাকায় ৭৫ হেক্টর ভূমিতে ঝাউবাগান করা হয়েছে। পাশাপাশি ২০ হেক্টর নিচু জমি উঁচু করে বাগান করা হয়েছে।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, সাগরের ঢেউয়ের তোড়ে গাছের মূল থেকে বালু সরে শিকড় বের হয়ে যাচ্ছে। স্যাঁতসেঁতে বালুর সৈকতে বিশাল এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য গাছের মূল। জোয়ারের ঢেউয়ের আঘাতে বালুর ওপর লুটিয়ে পড়ছে বড় গাছ গাছ। সৈকতে পড়ে থাকা গাছগুলো উপকূলের লোকজন কেটে নিয়ে যাচ্ছেন। আর নিচের অংশ সৈকতেই পড়ে থাকছে। গত ১৩ বছরে কুয়াকাটা জাতীয় উদ্যানসহ সংরক্ষিত বনাঞ্চলের অর্ধেকের ও বেশি বিলিন হয়ে গেছে। ১৮কিলোমিটার দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটা প্রকৃতির এক অপুর্ব লীলাভুমি। তাই কুয়াকাটা দেশি-বিদেশী পর্যটকদের আগমন চোখে পড়ার মতো। ১৯৯৮ সালে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ঘোষনার পর সারা বিশ্বের পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষন করে কুয়াকাটা। বিনিয়োগকারীরা ও হোটেল-মোটেল নির্মান করে কুয়াকাটাকে সৌন্দর্যের নগরী হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা চালাচ্ছেন। কিন্তু সাগরের অব্যাহত ভাঙ্গনের ফলে সমুদ্র সৈকত ছোট হয়ে আসছে সাগরে বিলিন হয়ে যাচ্ছে সৈকত লাগয়ো সংরক্ষিত বনাঞ্চল। কুয়াকাটার সৈকত ঘেষাঁ নারিকেল বাগান, তালবাগান ও জাতীয় উদ্যানের ঝাউবাগান পর্যটকদের আকৃষ্ট করে তুলতো।
উপকুলীয় বন বিভাগ পটুয়াখালী কার্যালয় সুত্রে জানা গেছে, পর্যটকদের কাছে আকর্ষনীয় করে গড়ে তুলতে ২০০৭-২০০৮ সালের অর্থ বছরে সৈকত ঘেঁষা ১০হাজার হেক্টর ভুমির উপর ঝাউবাগান গড়ে তোলা হয়। কুয়াকাটা বনের আয়তন প্রায় দু হাজার ১৬৫একর। তবে ২০০৭ সালে সিডরের পর থেকে ভাঙ্গনের মুখে পড়ে সংরক্ষিত বনাঞ্চল। প্রতি বছর অন্তত ১০০ একর বনভুমি ধ্বংস হচ্ছে। গত ১৩ বছরে কুয়াকাটা সংরক্ষিত বনের ১২৩৫দশমিক ৮০একর বনাঞ্চল সাগরে বিলিন হয়ে গেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ১৯৬০ সালে বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষা ১৯৭ একর সরকারী জমি ৯৯ বছরের লিজ নিয়ে বাগানটি করেছিলেন ফয়েজ মিয়া। “ফার্মস এন্ড ফার্মস” নামকরণ করেছেন। তিনি নারিকেল গাছ ছাড়াও অন্যান্য জাতের গাছ রোপন করেছিলেন। বাগানের মধ্যে পেয়ারা, কাজু বাদাম, লেবু, কুল, গর্জন বাগানসহ বিভিন্ন জাতের ফলদ ও ঔষধি গাছ ছিল। নারিকেল গাছ সংখ্যায় বেশী ছিল বলে নারিকেল বাগান নামে পরিচিতি পায়।
সকাল সন্ধ্যা নানা জাতের পাখির কলরব মুখোরিত থাকত বাগানটি। গহিন বনে প্রবেশ করতে বন্য হিং¯্রপ্রাণী ও অজগরের ভয় ছিল। জোসনা রাতে গাছে গাছে বানর ও বাদুরের দাপাদাপি, শেয়ালের ডাকাডাকি আর লুকোচুরি, শুকরের দূরহ দাঁত দিয়ে মাটির ভিতরের কেঁচো ধরে ভোজনের দৃশ্য এখন আর নেই। এসব অতিত হয়ে গেছে গত একদশক আগে। এ অঞ্চলের বেঁচে থাকা বৃদ্ধ মানুষগুলো দেখছেন কল্পনায়। বর্তমান প্রজন্মের কাছে রূপ কথার গল্প হয়ে গেছে।
কুয়াকাটা ট্যুরিস্ট সেন্টারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুমান ইমতিয়াজ বলেন, একসময় কুয়াকাটার সৈকতঘেঁষা নারিকেল ও তালবাগানে সারি সারি গাছ ছিল। এতে কুয়াকাটা পর্যটকদের কাছে আরও বেশি আকর্ষণীয় ছিল। সৈকতে ভাঙন ও সাগরের ঢেউয়ের আঘাতে তালবাগান বিলীন হয়ে গেছে। নারিকেল বাগানটি এখন বিলুপ্তির পথে। ঝাউবাগানও ভেঙে লুটিয়ে পড়ছে সৈকতে।
কুয়াকাটা পৌরসভার মেয়র বারেক মোল্লা বলেন, ভাঙনের কারণে সৈকত ছোট হয়ে আসছে। কুয়াকাটায় আকর্ষণীয় স্পটগুলো ভেঙে যাচ্ছে। বিলীন হয়ে যাচ্ছে বনের গাছ। ভাঙন রোধে টেকসই ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না হলে পর্যটকদের কাছে আকর্ষণ হারাবে কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত।
পটুয়াখালীর উপকূলীয় বন বিভাগ ও বন কর্মকর্তা মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, অবিরাম ভাঙন এখন সৈকতের দিকে এগিয়ে আসছে। ভাঙনের কারণে কুয়াকাটাসংলগ্ন এলাকায় অবকাঠামো উন্নয়ন করা যাচ্ছে না। গঙ্গামতি ও কাউয়ার চর এলাকায় নতুন করে বাগান সৃজন করা হচ্ছে। জলোচ্ছ্বাস প্রতিরোধে ২০ হাজার তালগাছ রোপণ করা হয়েছে। ভাঙন প্রতিরোধ পানি উন্নয়ন বোর্ডকে চিঠি দিয়ে অবহিত করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড কলাপাড়া কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী খান মোহাম্মদ ওয়ালিউজ্জামান বলেন, কুয়াকাটা সৈকতের স্থায়ী সুরক্ষা ও উন্নয়নের জন্য উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) তৈরি করে পাঠানো হয়েছে।