বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র, ১৪৩০
শামীম আহমদ তালুকদার।।
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। প্রকৃতিগতভাবেই বিশ্বের দুর্যোগপ্রবণ দেশগুলোর একটি। ঝড়-জলের সঙ্গে লড়াই করেই আমাদের বেড়ে ওঠা। এই দেশে বছর ঘোরে ছয় ঋতুর দোলাচলে। তবে এখন ষড়ঋতুর দেখা আর না মিললেও গ্রীষ্ম, বর্ষা আর শীতের পরিধি ও ব্যাপ্তি বেড়েছে। সঙ্গে বেড়েছে আরোপিত কিছু ভোগান্তিও। গ্রীষ্মে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে প্রচন্ড তাপ, বর্ষায় দুর্নীতি আর কূটনৈতিক ব্যর্থতার ফাঁদে জলাবদ্ধতা-বন্যা, আর শীতে জলবায়ু ইস্যুতে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ এর সঙ্গেই বসবাস আমাদের। বন্যা বাংলাদেশের জন্য অনেকটা অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। হাওড়-বাঁওড় অধ্যুষিত সিলেট-সুনামগঞ্জ-নেত্রকোনার হাওররক্ষা বাঁধ নিয়ে বহুকালের রাজনীতি আছে। এখানে বাঁধ নির্মাণে গাফিলতি নতুন নয়। এবারে সেই গাফিলতি চূড়ান্ত রূপ নিয়েছে। প্রথমে একবার বন্যায় বোরোর আবাদ তলিয়ে গেছে বানের পানিতে, কৃষক নিঃস্ব হয়েছে। সব শেষ হলে সবাই ঘরে ফিরে গেছে। তখনো বাঁধ নিয়ে আর ভাবেনি কেউ। এই দূরদর্শিতার সংকটে এবারে ঢলের পানিতে বাসছে জনপদ, বাসছে মানুষ। খাবার সংকট, পানির সংকট, ওষুধের সংকট অথচ পানি থই থই চারদিকে। মানুষের প্রাণহানী ও ধনসম্পদের ব্যাপক ক্ষতিতো হয়েছেই। এখন জীবন বিপন্ন।
সংবাদ কর্মী হিসাবে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছি। আমি কোন লেখক নই। তবে ভালো একজন পাঠক। স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা নিয়ে কিছু লিখবো ভাবছি। কিন্ত কোথা থেকে শুরু করবো বিপত্তি সেখানেই। চোখের সামনে যেন কেয়ামত দেখলাম। নিজের চোখে কেয়ামত দেখার পরও তার বর্ণনা লেখার সাহস বা জ্ঞান কোনটিই আমার নেই। তার পরও নিজের অনুভূতিটুকু তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
১৬ জুন (বৃহস্পতিবার) বিকেল পর্যন্ত শহরের ঘোলঘর পয়েন্টে সুরমা নদীর পানি বিপদ সীমার ৭০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ২৪ ঘন্টায় ১৮৫ মিলিমিটার বৃষ্টপাত রেকর্ড করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। সুরমা নদীর ছাতক পয়েন্টে ২২৪ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। আমার ঘরের ভিতর হাটু পানিতে দাঁড়িয়ে সর্বশেষ এই সংবাদটি লিখে পাঠাই। এর পরই সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক উপজেলা নির্বাহী অফিসার মামুনুর রহমান এর সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলি। নিজ এলাকা নতুন বাজার (ধারন), নতুন বাজার বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের ৪ তলা বিশিষ্ট ভবন, নতুন বাজার দাখিল মাদরাসা ভবন, নতুন বাজার সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন আশ্রয় কেন্দ্র হিসাবে ঘোষণা করার অনরোধ করি। তিনি আমাকে তাৎক্ষনিক পরামর্শ প্রদান করেন। এছাড়াও কথা বলেছি মাধ্যমিক মিক্ষা কর্মকর্তা পুলিন রায়, থানার অফিসার্স ইনচার্জ মাহবুবুর রহমান এর সঙ্গে।
ইতিমধ্যে সিলেট বিভাগের অন্যান্য জেলার সঙ্গেও যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। টেলিফোন নেটওয়ার্ক অকার্যকর হয়ে পড়েছিল। ছাতক বিদ্যুত বিতরন বিভাগের ইঞ্জিনিয়ার কাবির আহমদ এর সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করে জানতে পারি, বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে নিরাপত্তার স্বার্থে ও দুর্ঘটনা এড়াতে পুরো সিলেটের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছে। ফলে সিলেট বিভাগ কার্যত সারাদেশ থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
রাত ১১ টার পর থেকে আর কোথাও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। অপরদিকে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত ছিল। অজানা ভয় আতস্ক মনে কাজ করছে। কোনভাবে খাটের উপর খাট রেখে পরিবারের সবাইকে নিয়ে রাত কাটিয়ে দিলাম। সকাল বেলা সবাইকে নিয়ে আশ্রয় কেন্দ্রে যাবো। কিন্ত একদিকে প্রবল বেগে পানি প্রবাহিত হচ্ছে আপরদিকে ভারি বৃষ্টি অব্যাহত। এ যেনো মরার নউপর খরার ঘাঁ। আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার মত একটা নৌকাও নেই। পাশের বাড়ীর আতিউর রহমান চাচার একটা নৌকা সংগ্রহ করে তিন তিনজন করে মোট ৩৬ জন আশ্রয় কেন্দ্রে গিয়ে পৌছাই। এর মধ্যে নৌকা ডুবির ঘটনারও শিকার হতে হয়েছে। এই দিনে নতুন বাজার বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় ভবনে প্রায় ১ হাজার মানুস আশ্রয় নিয়েছিলেন। তার পরদিন থেকেই খাবার সংকট, পানির সংকট দেখা দেয়। দেখেছি খাবারের জন্য মানুষের হাহাকার।
তবে বন্যার পানি কমায় আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বাড়ি ফিরতে শুরু করেছেন বন্যার্তরা। অনেকেরই ঘরবাড়ি বানের পানিতে ভেঙে গেছে, নষ্ট হয়েছে আসবাবপত্র। নিম্ন আয়ের মানুষেরা সবচেয়ে বিপাকে পড়েছেন। স্মরণকালের ভয়াবহ এ বন্যায় তলিয়েছে সুনামগঞ্জের প্রায় ৯০ শতাংশ। এখনও বেশির ভাগ এলাকা জলমগ্ন। চলমান বন্যায় জেলায় কয়েক লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। আর হাজার হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মানুষ তার আপৎকালীন সঞ্চয় আর ত্রাণ দিয়ে বন্যা চলাকালীন সংকট পার করে দিতে পারবে। কিন্তু তার মূল বিপদ পানি নামার পরেই দেখা দেবে। কারণ টিনের চাল, ঘরের বেড়া পানিতে তলিয়ে গেছে। ঘরের আসবাবপত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হাঁস-মুরগি ভেসে গেছে। পানি নামার পর এগুলো মেরামতে বিপদে পড়বে তারা। এখনও বেশির ভাগ জায়গায় পানি রয়ে গেছে। বন্যা দুর্গত এলাকায় উদ্ধার কাজ ও ত্রাণ বিতরন করছেন সেনাবাহিনী, পুলিশ, র্যাব ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা। এছাড়ও দেশের বিভিন্ন জেলাসহ স্থানীয় বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগে ত্রাণ বিতরন করছেন। সিলেটবাসী কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ রাখবে আজীবন।
প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স এখন দেশের চালিকা শক্তি। রেমিট্যান্সের উপর ভিত্তি করে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। তারা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। একজন যুক্তরাজ্য প্রবাসীর কথা না বললেই। বন্যা দুর্গত গ্রামবাসীকে ৫ শত টাকা করে ও তার সহোদ ভাইকে ২ হাজার টাকা নগত অর্থ সহায়তা প্রদান করেছেন। অবশ্যই ২ হাজার টাকা গ্রহন করেননি ্ওই প্রবাসীর ভাই। প্রাণ বাঁচাতে আশ্রয় কেন্দ্রে উঠায় ওই প্রবাসী নাকি লজ্জাবোধ করছেন। কান্না বিজরিত কন্ঠে একথাগুলো বলছিলেন যুক্তরাজ্য প্রবাসীর বড় ভাই। বড় ভাইয়ের হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রমের টাকায় তিনি যুক্তরাজ্যে গিয়েছেন। কোটি কোটি টাকা ও বাড়ি গাড়ির মালিক হয়েছেন। এত কিছুর পরও ওই যুক্তরাজ্য প্রবাসী ভুলে যাননি তার বড় ভাইয়ের কথা। আমার দৃষ্টিতে এমন মানবিক প্রবাসী ভাইকে শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার দেওয়া উচিৎ।
যাক এবার মুল প্রসঙ্গে যাওয়া যাক। বারবার কেন সিলেটে বন্যা হচ্ছে? বন্যা কেন এত তীব্র আকার ধারণ করছে ? সিলেটে–সুনামগঞ্জে প্রধান নদীগুলো বিশেষত সুরমা নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়া, হাওর ও খাল বিল, জলাশয় ভরাট ও দখল হওয়া এবং উজানে মেঘালয়ে মাত্রাতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের কারণেই এই বন্যা। আগে প্রত্যেক বাড়ির সামনে পুকুর ছিল। বিশেষ করে নগরের ভেতরের সব পুকুর-দিঘি ভরাট করে বড় বড় বিল্ডিং হয়েছে। খালি মাঠগুলোও ভরাট হয়ে গেছে। এ কারণে পানি নামতে পারতেছে না। যেকোনো দুর্যোগেই আমাদের জন্য এটা একটা ভয়ের কারণ। সুরমা নদীর দুই রূপ। বর্ষায় দুকোল উপচে ডুবিয়ে দেয় জনবসতি। আর গ্রীষ্মে পানি শুকিয়ে পরিণত হয় মরা গাঙে। জেগে উঠে চড়। প্রায় ২৪৯ কিলোমিটার দৈর্ঘের সুরমা দেশের দীর্ঘতম নদী। ভারতের বরাক নদী থেকে সিলেটের জকিগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে সিলেট, সুনামগঞ্জ নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মেঘনায় মিলিত হয়েছে। এই নদী বছরের বেশিরভাগ সময় থাকে পানিহীন, মৃতপ্রায়। পলি জমে ভরাট হয়ে পড়েছে নদীর তলদেশ। ফলে শুষ্ক মৌসুমে সুরমা হয়ে পড়ে বালুভূমি। অপরদিকে অল্প বৃষ্টিতেই নদী উপচে নদী তীরবর্তী এলাকায় দেখা দেয় বন্যা। বৃষ্টিতে নদীর পানি উপচে তলিয়ে যায় হাওরের ফসল। ভরাট হয়ে পড়েছে এ নদীর উৎসমুখও। নদীর উৎসমুখের ৩২ কিলোমিটারে জেগেছে ৩৫টি চর। দুই দেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় যৌথ নদী কমিশনে সিদ্ধান্ত না হওয়ায় আটকে আছে উৎসমুখ খননও। বাংলাদেশ রাষ্ট্র সৃষ্টির প্রেক্ষাপটেও ছিল সত্তরের ঘূর্ণিঝড় ও ছেষট্টির বন্যার দুঃসহ স্মৃতি। ১৯৭০ সালের মহাপ্রলয়ঙ্করী বন্যা ও জলোচ্ছ¡াসে শুধু লোকই মারা যায় সরকারি হিসাবে ৫ লাখ। ওই বন্যায় উপকূলের ১৬ হাজার বর্গমাইল এলাকা প্লাবিত হয়েছিল। খাদ্যশস্য নষ্ট হয় ১২ লাখ ৯৮ হাজার টন। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২, ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালে বন্যায় বিপুল ক্ষতি হয়েছিল। এরপরও বাংলাদেশে বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটেছে বহুবার। বিশেষ করে ১৯৮৭, ১৯৮৮, ১৯৯৮, ২০০৪, ২০০৮ এবং ২০১৭ সালে প্রায় গোটা বাংলাদেশজুড়ে বড় বন্যা হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জেলায় বন্যা হয়েছে বহুবার।