শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ, ১৪৩১
ডাঃ মো: আলী হাসান।।
পর পর দুজন মেডিক্যাল অফিসারই চলে গেল। তারা তাদের সুবিধামত জায়গাতেই গেল এবং সেটা শুন্য পদেই। মাঝখানের সময়টাতে তারা না পারলো সম্মানের সাথে, উপযুক্ত মর্যাদার সাথে কাজ করতে, না পেলো জনগণ তাদের থেকে তেমন কোন সেবা। পরে দেখলাম সেই সময়ের বাংলাদেশের সমস্ত উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রের অবস্থা কম বেশি প্রায় একই। যে এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল সে এলাকায় মেডিক্যাল অফিসারগণ উপজেলা প্রোপারে থেকে যাতায়াত করতো, আর যেখানে অবস্থা খারাপ সেখানে কি অবস্থা হয় তা ঐ দুটো কেন্দ্রের কথা মনে করলেই বুঝা যায়।
এই মেডিক্যাল অফিসারগণ যেখানে যে কয়দিনই চাকরি করে থাকুক না কেন সে কয়দিন তারা কত আত্মমর্যাদা বিসর্জন দিয়ে, মনের সাথে যুদ্ধ করে, কত অপমান সহ্য করে কাজ করেছে এটা শুধু ভুক্তভোগীরাই উপলব্ধি করতে পারবে। একটু উদাহরণ দেই, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রায়ই ওদের রোগী পেতাম, বেশির ভাগই এসেছে তাদের দেয়া চিকিৎসা পছন্দ হয়নি। তাদের ধারণা বড় হাসপাতালে বড় ডাক্তার থাকে, রোগীদের একটা কমন কথা ” ঐ বাঙ্গালী ডাক্তার দেখিয়েছিলাম”। এই কষ্টে আমার এক ক্লাশমেট পরের বিসিএস দিয়ে এ চাকরি বাদ দিয়ে পুলিশে চলে গেল। অনেকদিন পর ওর সাথে আমার দেখা আমি যে উপজেলায় আছি সেখানে, এ এস পি হিসেবে এসেছে ফিল্ডট্রেইনিংএ। ক্যাডার বদলানো কারণ জিজ্ঞেস করলে বললো ” মেম্বার পর্যন্ত বলে ডাক্তার, স্যারকে তাড়াতাড়ি দেখে দেন, স্যার হলো থানার কনস্টেবল। এ রকম অপমান আর সহ্য করতে পারিনি, শেষে ক্যাডার বদলিয়ে ফেললাম”। সে খুব গরীব ঘরের ছিল, ও নিজে টিউশনি করে এমবিবিএস এর খরচ চালিয়েছে, ব্যক্তিজীবনে সে ছিল অনুকরণীয় সৎ। উপজেলা লেভেলে চাকরি করেও মর্যাদার দিক থেকে আমাদের অভিজ্ঞতা একই এমন কি জেলা বা বিভাগীয় পর্যায়েও তাই।
স্বাস্থ্যা ব্যবস্থ্যাপনায় এ রকম উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রে যারাই চাকরি করে এসেছে তাদের পুরো মেধাটাই বিফলে গিয়েছে। একটা চিকিৎসা দিতে গেলে যে শুধুমাত্র একজন ব্যক্তি দিয়ে সম্ভব না, এর সাথে আনুসঙ্গিক এবং অত্যাবশ্যকীয় আরো অনেক কিছুই দরকার হয় তা এই স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় নাই। ফলে সেখানে একজন মেডিক্যাল এ্যাসিস্ট্যান্ট যা দিতে পারে, একজন মেডিক্যাল অফিসারও এর চাইতে বেশি কিছু দেবার থাকেনা। দীর্ঘদিন যদি একজন মেডিক্যাল অফিসারকে এই রকম পরিবেশে কাজ করতে হয় তাহলে তার ভিতরে সুদূরপ্রসারি এক প্রভাব পড়ে, সে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ে, তার ভবিষ্যৎ জীবনটা অন্ধকারের দিকে ধাবিত হয়, বিরাট হতাশা তাকে তিলে তিলে গ্রাস করতে থাকে, ভবিষ্যতে জাতিযে একটা মেধাবী, বড় কিছু একটা সম্পদ পেতো সেটা হারিয়ে ফেলে।
যারা দেশ চালান তারা মনে করে বাড়ির দরজায় বড় ডাক্তার এনে দিয়েছে, কিন্তু জাতির কাছ থেকে কি যে হারিয়ে ফেললো তা একবারও অনুধাবন করতে পারেনা, অথচ ব্যবস্থাপনাটা রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখে যদি বাস্তবতার নিরিখে দেখা হয় তাহলে সর্বোচ্চ সেবা দেয়া সম্ভব হয়। এতে একজন মেডিক্যাল অফিসারের মেধা দক্ষতা পুরোপুরি কাজে লাগানো যায়, অন্যদিকে তাঁদের সামাজিক মর্যাদা সুনিশ্চিত করা যায়। চলবে…
লেখক: (শিশু বিভাগ) এর সাবেক সহকারী অধ্যাপক, শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বরিশাল।